(রমিত দে)
Friday, January 15, 2016
অশোকবিজয়
রাহা
(১৯১০-১৯৯০)
(কাব্যগ্রন্থ- ‘ডিহাংনদীর বাঁকে’, ‘রুদ্রবসন্ত’, ‘ভানুমতীর মাঠ ’, ‘জলডম্বরু পাহাড় ,’শেষ চূড়া’, ‘রক্তসন্ধ্যা’ , ‘উড়ো চিঠির ঝাঁক’, ‘যেথা এই চৈত্রের শালবন’ , ‘ঘন্টা বাজে পর্দা সরে যায়’ , ‘পৌষ ফসল’...)
সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের
অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আর ক্লান্তি। মানসিক
ভাবে বিপর্যস্ত ভ্যান গঘের আশ্রয় সে সময় সেন্ট রেমির মানসিক হাসপাতাল। বেঁচে থাকার
সব রাস্তা শেষ হয়ে যাচ্ছে কোথাও যেন, কোথাও যেন সম্পর্ক বন্ধুত্ব অনুভূতি শব্দগুলোর মধ্যে ছেনি হাতুড়ির শব্দ আসছে, পোড়া গন্ধ ভেসে আসছে প্রতিটি মানবিক স্পর্শ থেকে। এসময় মাঝে মাঝেই আত্মহত্যার কথা ভাবতেন গঘ, নিজের চারপাশের ভাঙাচোরা মুখটাকে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতেন
আর বেড়ে উঠত ব্যর্থতার,বিষাদের
ফেনা।অথচ যে কাজটা তিনি সেদিনও ছাড়েননি, আঁকড়ে ধরেছিলেন একমাত্র ভিক্ষাপাত্র হিসেবে তা হল তাঁর ছবি আঁকা। রঙের মধ্যে
দিয়েই যেন বাস্তবের অতৃপ্তি থেকে পৌঁছোতে চাইতেন কল্পনার উৎসে। আর এভাবেই সেন্ট
রেমির পাগলাগারদ থেকেই তিনি একদিন এঁকে ফেললেন সেই বিখ্যাত “মালবেরী ট্রি” যা কিনা অনাদৃত পরিত্যক্ত নির্মম রুক্ষ পাগলাগারদের পাথর
থেকে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে কোরকসত্যের অভিমুখে। গার্ডেন অফ অ্যাসাইলাম থেকে একটা
শূন্যতাকেই কি নির্মূল করতে চেয়েছিলেন ভ্যান গঘ? তাই কি তাঁর মালবেরীতরু ক্ষণকালীন একটি কুঁড়েঘর ছেড়ে জীবন ও জগতের অভিনব
কল্পনাসমগ্রে ঠিকানা লিখতে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ক্যানভাস জুড়ে? ভয়ংকর এক শূন্যতাকে পেরোতে কি শিল্পী আশ্রয় নিলেন এক বিশেষ
আলোপদ্ধতির? জীবন যেখানে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে
কল্পনাই কি তখন ক্রমজায়মানতার হদিশ দিচ্ছে? এ সমস্তই আমাদের প্রশ্ন এবং যথারীতি এদের উত্তর আমরা জানি না । কিন্তু এত কথা
বলার একটাই কারণ অশোকবিজয় রাহার কবিতার সামনে আজ যখন এই একই রকম প্রচুরতা আর
প্রাণের সরস লক্ষ্য করি তখন বারবার গঘের সেই মালবেরী ট্রির কথা মনে পড়ে যেখানে
একজন শিল্পী ভাবের প্রকাশকে ভাষা থেকে রং থেকে দৃশ্য থেকে জন্ম থেকে বারবার জীবন
সত্যের দিকে অতিক্রম করাতে চাইছেন ; অশোকবিজয় রাহাও কোথাও যেন এই সামান্য সত্যটুকুই খুঁজে গেছেন তাঁর কাব্যিক
লাবণ্যে। আসলে ভাষাকে কেবল ভাষা দিয়ে প্রকাশের ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ আর তাই হয়ত ভাষার
মধ্যেই কবি বা লেখক বা শিল্পীরা একটি মুক্ত ও মুক্তিক্ষেত্র গড়ে নেন , এবং সেটাই সৃষ্টির অহংকার। “মায়াতরু” থেকে “ভানুমতীর মাঠ” এক একটা কবিতায় যে প্রাণ কল্লোল প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তিনি
সেখানে কেবলমাত্র একটি রূপ ঘুমায় না বরং একাধিক অরূপও জেগে থাকে পাশাপাশি , ফণা নেড়ে নেড়ে এরা যখন নাচে তখন এরাই হয়ে ওঠে অশোকবিজয়
রাহার কবিতার জীবন্ত বিদ্যুৎ। তাঁর কবিতায় প্রকৃতির অঢেল সমাহার যেমন লক্ষ্য করা
যায় তেমনি তা কেবল অবধারিত কোনো জৈব প্রাণশক্তির কার্যক্রম হয়ে শেষ হয়ে যায়না, বরং গঘের ‘মালবেরী
ট্রি’ র মতই
অশোকবিজয়ের “মায়াতরু” ক্রমাগত বেড়ে চলে আলোর দিকে, বাস্তবের নিক্তি মাপা পরিধি টেনে বেঁকে বাড়িয়ে নেন কবি নিজস্ব চেতনায়। তাই তো “মায়াতরু”তে একটি
গাছকে আমরা কত সহজে লক্ষ হীরার মাছ হয়ে যেতে দেখি , কখনো সে জ্বর হয় তো আবার পরক্ষণেই ঝিকিরমিকির আলোর রূপোলী ঝালর। স্পষ্টতই বোঝা
যায় নির্সগচিত্রনের সীমাবদ্ধতায় আর প্রাকৃতিক প্রতিমা জৌলুষেই কেবল অশোকবিজয় রাহার
চিন্তন আবদ্ধ নয় বরং তা দৃশ্যের সব স্থানে ঘুরে ঘুরে একটা অতিক্রমণ খুঁজছে ,একটা উৎকেন্দ্রিকতা খুঁজছে, আর এই হয়ত কবির সেই কল্প ফাটল যা দিয়ে ভাষা থেকে ভাষাহীন নৈঃশব্দ্যে পৌঁছে
যাচ্ছেন কবি। নদী পাহাড় অরণ্যের দেহ শুধু নয় তাদের ভেতরের মনগুলোকে উঁচু নিচু বৃহত
জগতটাকে বারবার নতুন নতুন অভিনব রূপকল্পে সাজিয়েছিলেন অশোকবিজয় রাহা। তাই হয়ত তাঁর
কবিতার মূল্যায়ন করতে গিয়েই অনেকই নাগরিক অশোকবিজয় , দার্শনিক কিংবা অধ্যাপক অশোকবিজয়ের পাশাপাশি এক আদিম অরণ্যকের উদাহরণ টেনেছেন , যাঁর কাছে দৃশ্যের নিশ্চলতাকে ভেঙে বেরিয়ে এসে প্রকৃতিকে
হাতড়ে বেড়ানোর দৃশ্যটাই বারবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আসলে অশোকবিজয় রাহার কবিতা পড়তে
পড়তে বারবার কোথাও মনে হয়েছে তিনি শব্দ নিয়ে প্রকৃতি নিয়ে যতটা না কাজ করেছেন তার
থেকে অনেক বেশি ওই প্রাকৃতিক অর্কেষ্ট্রায় জড়িয়ে থাকা আলোকে নিয়ে কাজ করে গেছেন।
লক্ষ্য করে গেছেন আলো পড়লে আলো ফেললে একটি অনিবার্য লক্ষ্যেও কিভাবে অনিশ্চিত নতুন
দৌড় শুরু হয় , কিভাবে একটি নির্ধারিত আলোর আদরে
বড় হয়ে ওঠে অপর এক অতিরিক্ত। “মায়াতরু” কবিতাতেও কবি আদতে ওই আলোর কাছেই সমর্পণ করতে চেয়েছেন।
প্রকৃতির মধ্যেই যেন ওঁত পেতে রয়েছে একধরনের প্রতীক্ষা। একটি আনন্দের একটি বিষাদের
আবার একটি আনন্দের-চক্রাবৃত্ত এই পরিক্রমণের মধ্যে দিয়ে অশোকবিজয় আমাদের তামাটে
মানুষদের বারবার একটি অভাব থেকে একটা না থাকা থেকে একটি শূন্যতা থেকে নিয়ে চলেছেন
নতুন এক রঙের দিকে যেখানে বাঁচার কথা আছে প্রত্যাশার কথা আছে । ‘মায়াতরু’ কবিতাতেই উপলব্ধি করি যে জীবন ও জগতে আমরা দাঁড়িয়ে আছি পিচ্ছল ও অবসাদ, যে স্থানিক ও কালিকে আমাদের চোখের পাতায় ঘুমে ঘাম জড়িয়ে আছে
সেখানেই কবি তাঁর সবকিছুকে ভিজিয়ে রেখেছেন আলোর জারকে। এক্ষেত্রে তাই নন্দলালের
ঢঙেই হয়ত অশোকবিজয়ের কবিতার মননবিচিত্রতার সাক্ষাৎ টানা যায়, যেখানে একজন কবির ক্রিয়েটিভ ইমপালসে বারবার অনুরণিত হচ্ছে-“ গাছপালা ও প্রকৃতির যাবতীয় জিনিস আলোর মধ্যে ডোবান আছে ও
আলোর দিকে গজাচ্ছে। প্রকৃতির সব বস্তুই আলোর দ্বারা সিক্ত হয়ে আছে। তার চার ধারে
আলো,
রূপের ভিতর ও বাহিরে আলো। প্রকৃতির দৃশ্য আঁকার সময় কিংবা
দৃশ্য দেখে কেবল এই আলোর কথাই মনে হয়। একখন্ড স্ফটিকের মত আলোয় ঝলমল করছে যেন।“-‘মায়াতরু’র শেষ
পংক্তির রূপালি আলোর ঝালর তাই কেবল অক্ষর সমৃদ্ধ অতিরঞ্জন নয় বরং
অক্ষর-আলো-অবচেতনের দলগত মিথস্ক্রিয়া।
কবি অশোকবিজয় রাহার প্রথম
কাব্যগ্রন্থ “ডিহাং নদীর
বাঁকে” প্রকাশিত হয়
১৯৪১ সালে। পরে একে একে “রুদ্রবসন্ত” (১৯৪১), “ভানুমতীর মাঠ” (১৯৪২), “জলডম্বরু পাহাড়” (১৯৪৫), “রক্তসন্ধ্যা” (১৯৪৫) কিংবা “উড়োচিঠির ঝাঁক” (১৯৫১), “যেথা এই চৈত্রের শালবন”, “ঘন্টা বাজে! পর্দা সরে যায়” এবং “পৌষ ফসল” । আশ্চর্যের ব্যাপার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমকালীন বাংলা
কবিতার প্রেক্ষাপটে একটি কবিতার জন্য সুভাষ যেখানে চাষী শ্রমিকের কাছে আগুন ভিক্ষা
করলেন,
মনীষ ঘটক যেখানে তার ‘ধীমহি’ কবিতায় সাবিত্রী মন্ত্রের ব্যাখান দিলেন কিংবা ‘ভুখা মিছিল’ বা ‘কাস্তে’ কবিতায় দিনেশ
দাস যেমন কৃষিবিপ্লব বা বলশেভিক বিপ্লবের চেতনায় সমকালীন কবিতাকে চিহ্নিত করতে
চাইলেন তখন অশোকবিজয় রাহার “পিটুলি পাখির ডাকে” ভেসে এল রাবীন্দ্রিক রোমান্টিকতার নতুন সংস্করন। আসলে দর্শণজাত বিস্ময়ে বা
জীবন্ত কবিতার সমর্থনে অশোকবিজয়ের কবিতার সন্মোহন ভাঙানো সম্ভব নয় বরং তাঁর কবিতার
চিরকালীন বলতে একধরনের সান্দ্রতা একধরনের হৃদয়বৃত্তি যা চিৎকৃত কবিতার থেকে বেশ
কিছুটা দূরে। রবীন্দ্র সাহিত্যের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন অশোকবিজয় এবং স্বয়ং
রবীন্দ্রনাথও একসময় সজনিকান্ত দাসের
শনিবারের চিঠিতে তাঁর ‘ভানুমতীর মাঠ’ কাব্যগ্রন্থের ভূয়সী প্রসংশা করেন;রবীন্দ্রনাথ তাঁকে তরুণ চাঁদ বলে অভিহিত করে লিখেছিলেন..."আকাশের চেয়ে আলোক বড়,/মাগিল যবে তরুণ চাঁদ/রবির কর শীতল হয়ে/করিল তারে আশির্বাদ।"-অশোকবিজয় রাহার কবিতার চরাচর জুড়ে নিসর্গ প্রকৃতির
চিত্রবর্নণা, যেখানে নৈঃশব্দ্যটুকুও
ভরে যায় মায়াপ্রকৃতির বিস্ময়ে। কিন্তু কেবল কি বিস্ময়? কেবল কি অশরীর শব্দের মেধা? হয়ত না , একধরনের জীবনেরও ভিখারী কবি অশোকবিজয় যিনি সত্ত্বার মাঝেই বিশুদ্ধ শাশ্বতের
খোঁজে মগ্ন হয়ে উঠেছেন মাঝে মাঝেই, তাই কি “ব্যক্তমধ্য’ কবিতায় আমরা একজন কবির কল্পনা পেরিয়ে সমাজ পেরিয়ে জড়
দিনযাপন পেরিয়ে আরও বড় কোনো সত্যের সাক্ষী হয়ে উঠি? সত্যিই তো শব্দের স্পর্শে সুবাসে কি আছে? শরীর নামের এই ন্যাংটো কুটিরে কি আছে? কেবল এক দীর্ঘ শান্ত মেটামরফসিস ছাড়া ! ওই যে একটা বিন্দু,তারপর এক বিরাট আকার তারপর আবার বিন্দু এবং তারপর কিচ্ছু
নেই-অশোকবিজয়ও কোথাও যেন তাঁর কাব্যিক যুক্তি কিংবা ইম্প্রেশনিস্ট ধারনা থেকে সরে
গিয়ে শেষের দিকে খুঁজে ফিরছিলেন অনিশ্চয়ে বিলুপ্ত হওয়ার একটি মুদ্রনবিন্যাস।
আর শেষমেশ যে কবিতার কাছে না
এলে অশোকবিজয় রাহার ভাবনাবোধের ভূখন্ডটি সমাপ্ত হয় না তা হল ‘দুর্বোধ্য’’; কেবল নামকরণেই নয়, সম্পূর্ণতার মধ্যে দুর্বোধ্য ওই আদিগন্ত অনুপস্থিতিতেই তো একজন শিল্পী ধীরে
ধীরে স্থিতধি হয়ে ওঠেন। উঠেছিলেন কবি অশোকবিজয় রাহাও। যে অশোকবিজয়কে আমরা
রূপকথাধর্মী চিত্রকল্প রচনা করতে দেখছি তাঁর সামগ্রিক উচ্চারণে সেই তিনিই আবার
সায়াহ্নবেলার গোপন নির্জনতায় একধরনের প্রতিন্যাসের মুখোমুখি করলেন আমাদের। কবিতার
কাল্পনিক আয়তন ছিঁড়ে বেড়িয়ে তখন তাঁর আয়োজন বাস্তবতা নামের ব্ল্যাকহোলটিকে খুঁজে
বের করার,তাই তো কবি কেবল উদাস পথিক নন বরং এক আভ্যন্তরীন
দ্বন্ধের সামনে প্রশ্ন রাখছেন নিজেকেই-“লোকটা কেন যে এল/ কেন চলে গেল/বোঝাই গেল না”- এবং এই অসমাধিত ধাঁধাই হয়ত আমাদেরকেও ভাবায়, হাতিয়ার করে তোলে কবিতাকে আর কবি সে তাঁর অবস্থানবিন্দু
থেকে কয়েক দশক দূরে গেলেও থেকে যান একেবারে সমকালের আধো আলো আধো অন্ধকারে…
(রমিত দে)
(রমিত দে)
মায়াতরু
এক যে ছিল গাছ
সন্ধ্যে হলেই দু হাত তুলে জুড়ত
ভূতের নাচ।
আবার হঠাৎ কখন
বনের মাথায় ঝিলিক মেরে মেঘ উঠত
যখন
ভালুক হয়ে ঘাড় ফুলিয়ে করত সে গরগর
বিষ্টি হলেই আসত আবার কম্প দিয়ে
জ্বর ।
এক পশলার শেষে
আবার কখন চাঁদ উঠত হেসে
কোথায়-বা সেই ভালুক গেল, কোথায়-বা সেই গাছ,
মুকুট হয়ে ঝাঁক বেঁধেছে লক্ষ
হীরার মাছ।
ভোরবেলাকার আবছায়াতে কাণ্ড হত কী
যে
ভেবে পাইনে নিজে,
সকাল হল যেই
একটিও মাছ নেই,
কেবল দেখি পড়ে আছে ঝিকিরমিকির
আলোর
রুপালি এক ঝালর।
একটি চলচ্চিত্র
জানালায় বসে বসে দেখি চেয়ে চেয়ে
ছোট্ট তারাটি নামে মেঘ-সিঁড়ি বেয়ে,
সেতারের দ্রুত তালে নাচে তার পা,
সন্ধ্যার সরোবরে ধুয়ে যাবে গা ,
চোখে মুখে হাসি তার করে ঝলমল,
ছোট ছোট হাত দুটি ভারী চঞ্চল,
ঝলকায় মণিহার, চমকায় দুল,
দুটি গালে নাচে তার ফুরফুরে চুল,
সিঁড়ি বেয়ে নেমে নেমে এলো শেষ ধাপ,
হাত তুলে এইবার জলে দিল ঝাঁপ,
একটু সাঁতার কেটে ডুব দিল- টুপ,
সন্ধ্যার সরোবর একেবারে চুপ ।
ভাঙল যখন দুপুরবেলার ঘুম
ভাঙল যখন দুপুরবেলার ঘুম
পাহাড় দেশের চারদিকে নিঃঝুম
বিকেলবেলার সোনালি রোদ হাসে
গাছে পাতায় ঘাসে ।
হঠাৎ শুনি ছোট্ট একটি শিস,
কানের কাছে কে করে ফিসফিস?
চমকে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি,
এ কী !
পাশেই আমার জানলাটাতে পরীর শিশু
দুটি
শিরীষগাছের ডালের পরে করছে
ছুটোছুটি ।
অবাক কান্ড- আরে !
চারটি চোখে ঝিলিক খেলে একটু পাতার
আড়ে !
তুলতুলে গাল, টুকটুকে ঠোঁট, খুশির টুকরো দুটি
পিঠের পরে পাখার লুটোপুটি,
একটু পরেই কানাকানি, একটু পরেই হাসি-
কচি পাতার বাঁশি-
একটু পরেই পাতার ভিড়ে ধরছে
মুঠি-মুঠি
রাংতা আলোর বুটি ।
এমন সময় কানে এলো পিটুল পাখির ডাক,
একটু গেল ফাঁক-
সমুদ্র স্বপ্ন
হঠাৎ সমুদ্র থেকে লাফ দিয়ে ওঠে এক
চাঁদ
‘কি আশ্চর্য ! দেখো দেখো !
(সুজাতার দু’চোখে বিস্ময়!)
‘এমন প্রকান্ড চাঁদ দেখেছ কখনো?’
(সুজাতার দু’চোখের তারা
কী উজ্জ্বল হয়ে ওঠে !)
‘এমন প্রকান্ড চাঁদ?- না তো !’
(হঠাৎ চাঁদের দিকে গলুই ফেরাই)
সত্যিই সেদিন
সমুদ্রে চাঁদের স্বপ্ন, সমুদ্রের স্বপ্ন দেখে চাঁদ,
চাঁদের চেয়েও বড়ো আরেক বিস্ময়
ছিল তার দুটি চোখে
আমি তা দেখেছি !
সে দিনের রূপালি জ্যোৎস্নায়
ছিপ ছিপ দাঁড় ফেলে ফেলে
জলের ঝালর ছিঁড়ে ছিঁড়ে
চলে গেছি বহু দূরে – সুজাতা জানে নি কিছু তার,
সুজাতার চোখে ছিল চাঁদ,
আমারো দুচোখে ছিল আরো এক
স্বপ্নজাল-ফাঁদ
দুজন দুখানে বন্দী !
সে-সমুদ্র, সেই চাঁদ কত দূরে চলে গেছে আজ !
একবার গলুই ফেরাই,
নিরেট চাঁদের মুখে চাই,
কী ঠান্ডা পাথর চাঁদ! বরফের মতো
সাদা মুখ !
এ-চাঁদের মুখে চেয়ে সমুদ্র পাথর
হয়ে গেছে ।
বহুক্ষণ চুপ করে দেখি,
(সমুদ্র পাহাড় চাঁদ স্থির হয়ে আছে
পাথরে খোদাই,
দেহের শ্রায়
রক্তে ঝিঁঝিঁ ডাকে!)
হঠাৎ একটগু দূর ও দিকের খাঁড়ির
কিনারে
যেখানে সমুদ্র জলে ডুবে আছে পাহাড়ের লেজ-
কারা হাসে?
(কারা যেন আসে,)
ধীরে-ধীরে স্পষ্ট হয় কথা,
একটু পরেই
ডানা-মেলা সাদা হাঁস-ছুটে আসে
ছোটো সে শাম্পান !
‘দেখো, দেখো,কী সুন্দর চাঁদ
!
এমন প্রকান্ড চাঁদ দেখেছ কখনো ?’
তরল রূপালি কন্ঠে সুর বাজে জলের
মতন-
ডানা-মেলা সাদা হাঁস তীর বেগে উড়ে
যায় দূরে !
দাঁড় হাতে চুপ করে থাকি
নিরেট চাঁদের মুখোমুখি
ঈশ্বরের মতো বোবা !
এরা
গেরুয়া পথের ধারে একদল তামাটে
মানুষ
পাথরে হাতুড়ি পেটে এই সারা
চৈত্রের দুপুর,
ধূলা শুঁকে শুঁকে এসে চেয়ে যায়
একটি কুকুর,
পাশ দিয়ে ছেঁড়া-ছাতা হেঁকে যায় ‘সেলাই-বুরুশ’।
বিশাল মোটর এক দিয়ে যায় ধমক
প্রচুর,
হঠাৎ ঝলকে চোখে কোনো এক সোনার ঈগল,
চিলের চিৎকার মেশা ঝলসানো রোদের
পিতল
ভাঙা বাসনের ডাকে দিয়ে যায় ঝন ঝন
সুর।
দিনের উজ্জ্বল ভিড় একবার গিয়েছে
সকালে,
আরবার দেখা দেবে বিকেলের সোনালি
আলোয়,
এদের হাতুড়ি পেটা তখনো চলছে
একতালে
আকাশের ইঁটের রঙ যতক্ষণ ধূসর না
হয়,
তারপর ঘাম যত ঝরে ঝরে রয়েছে কপালে
শেষবার মুছে যাবে খালি হাতে
বাদামী চেটোয় !
মাঝরাতে
মাঝরাত
অন্ধকার ঘর
দেওয়াল ঘড়ির ঠক ঠক
টেবিলে আবছা বুদ্ধমূর্তি ।
ঘুম আসে না তা
শুয়ে শুয়ে ভাবে প্রবাসের দিনটা
ভোরবেলা কোথা থেকে এসেছিল সেই
ফুটফুটে শিশু-
দরজা দিয়ে বাড়িয়েছিল টুকটুকে মুখ?
চোখে ভাসে আমবাগানের সেই কিশোর
কাঠবেড়ালীর সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে
সমস্ত সকাল,
দুপুরবেলা এসেছল সেই তরুণ-তরুনী
ছেলেটির হাত বাঁশি, মেয়েটির কানে শিরীষফুল
যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে দুজনে-
এরা সব গেল কোথায়?
আর বিকেলবেলার সেই দরবেশ
সারঙ্গী বাজিয়ে গেয়েছিল একটা ভজন
কী যেন ছিল কথাগুলি-
আর ভাবতে পারে না সে
শরীরে একটা ঝিমঝিম অবসাদ
মাথার ভিতরে ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশা
বুদ্ধমূর্তিটা মিশে যাচ্ছে
অন্ধকারে
ক্ষীণ হয়ে আসছে ঘড়ির শব্দ
জানালায় চুপ করে চেয়ে আছে
কালপুরুষ ।
গলির মোড়ে
ছেঁড়া চট, ফুটো মগ, ভাঙা সানকি
পাশে হাঁ করে পড়ে আছে এক চামড়া
ঢাকা কঙ্কাল
থমকে দাঁড়াই
চুপ করে ভাবি;
পথের ধার পথেই শোধ
কবে শোধ হবে ওর কাছে মানুষের ঋণ?
বড়ো রাস্তায় ট্রাফিকের ভীড়
অবিরল জনস্রোত
বিকেলের ভাটার টান,-
হঠাৎ এ কী,
আমি কি সত্যি দেখছি?
ওর টাকরায় চিকচিক করছে পড়ন্ত রোদ
হাঁ-করা মুখে একটা অদ্ভুত হাসি
অদ্ভুত, অদ্ভুত হাসি-
ও কি শুনতে পাচ্ছে একালের
মৃত্যুঘন্টা?
প্রতীক্ষা
একটি আলোর পাখি ধরা দেবে বলে
বসে আছি ।
বিকালের দেবদারু গাছে
জড়ালো সোনার জাল-
কিছু সুতো জড়ায়েছে মেঘে
কিছু ঘাসে।
একপাশে মেহেদির ছায়া
চুপিসারে বুকে হাঁটে,
বুটি-কাটা পেয়ারার ডালে
লেগে আছে লাল গিরগিটি,
বাখারি বেড়ার গায়ে পিলপিল পিঁপড়ের
সারি।
টিক টিক চলেছে সময়...
হঠাৎ পাখার ঝটপট
কান পেতে চারদিকে চাই
গেটের কিনারে
দুলে ওঠে জুনিপার গাছ
একটু পরেই
ক্রোটনের ঝোপ থেকে ছুটে আসে
খিলখিল হেসে
একটি মিকির মেয়ে
চোখে মুখে খুশির ঝলক
বুকে দুটি তিতিরের ছানা ।
নেপথ্য সংলাপ
দৃশ্যপট ; বিকেলের নির্জন খোয়াই। পিছনে র ক্তরঙের আকাশ। দূরে একটা
মাথাভাঙা তালগাছ। কুশীলবঃ দুটি অদৃশ্য কন্ঠস্বর ।
কী খবর?
ভাল।
হাসছ যে?
চোরাই পথে ঢুকে পড়েছিলাম ওদের
ঘাঁটিতী।
সেঁধিয়ে গিয়েছিলাম ওদের বুদ্ধির গোড়ায়
নেড়ে দিয়ে এলাম কলকাঠি।
তারপর?
আর ভাবতে হবে না আমাদের
এবার নিশ্চিন্ত।
বলো কী?
কী হারে বাড়ছে ওদের সংখ্যা, জানো?
জানি; ওটা বাইরের ছবি
ভিতরে উলটো পাকে ঘুরছে চাকা
ওরা ফিরে যাচ্ছে পিছনের দিকে ।
তার মানে?
এখন ওরা ডাঙায় বাঘ, জলে কুমির, গর্তে সাপ।
ওরা আজ ডানা মেলে উড়ছে আকাশে
সে খবর রাখো?
সে তো চোখেই দেখে এলাম
দিনরাত শূন্যে টহল দিচ্ছে রাক্ষুসে শকুন
শুধু নিচের আকাশে নয়
ল্যাজের ঝাপটায় ঠেলে উঠছে মহাকাশে।
তবে?
তাতে কী?
ওদের নিজের মধ্যেই চলেছে রেষারেষি
শুরু হয়ে গেছে খেয়োখেয়ির পালা ।
সত্যি তাই?
ঠিকই বলছি।
কিন্তু থাক, সে কথা,- একটা কান্ড হয়েছে এদিকে।
কী শুনি।
সেই আদ্যিকালের আপেলের বিচি
এখনো গিজগিজ করছে এদের পেটে
সেগুলো চাঙা করে এসেছি এবার।
ফল হয়েছে তাতে?
বিলক্ষণ,
এখন ঘরে-বাইরে পথে-ঘাটে-
বুঝেছি।
ওহো, ভুল হয়ে গেছে একটা-
কী হলো?
এসব অন্ধকারে মানায় ভাল,- যাই
সূর্যটাকে নিবিয়ে আসি।‘
হঠাৎ হু হু কর ছুটে যায় একটা দমকা হাওয়া । উপর থেকে ধীরে
ধীরে নেমে আসে একটা কালো পর্দা। কিছুক্ষণ সব চুপ। একটু পরে শুরু হয় ঝিঁঝির ঐকতান।
দুর্বোধ্য
লোকটা কেন যে এল
কেন চলে গেল
বোঝাই গেল না,
রেখে গেল একমুঠো ছাই
সেও হুস হাস
নিয়ে গেল দমকা বাতাস ।
ভানুমতীর মাঠ
জ্বলন্ত ঘাসের শিখা- ধূ ধূ লাল
সূর্যাস্ত-আগুন,-
ধসানো ইটের পাঁজা একাধার অট্টহাসি
হাসে,
চারদিকে পোড়া মাটি-খাঁ খাঁ করে
দুর্ভিক্ষের মাঠ,
একধারে ছায়া ফেলে ভাঙা-পাড় নদীর
কঙ্কাল ।
ভাঙা মন্দিরের গায়ে বটের ঝাঁকড়া
মাথা থেকে
হঠাৎ টিকির মতো উড়ে যায় আগুনের
পাখি,
আকাশের ডিমে বসে ডাকে এক অদ্ভুত
টিট্রিভ,
মাটির ঢিবির গায়ে জ্বলে ওঠে
তুবড়ির আলো ।
পৃথিবীর হৃদপিন্ড এইখানে ডিমি
ডিমি বাজে
পড়ো জমি স্বপ্ন দেখে চষা মাঠ
ফসলের ক্ষেত,
মরা নদী উড়ে চলে স্ফীত পালে জলের
যৌবনে
দূর থেকে ভেসে আসে মসৃণ দিনের কোন
সুর ।
পৃথিবীর হৃদপিন্ডে শুনি বসে বহু
রূপকথা,
এইখানে একদিন হাড় থেকে হবে
মায়াপুরী,
উজ্জ্বল বৃষ্টির হাসি একরাশি
ঝরাবে হঠাৎ-
নূতন আলোর বীজে বোনা হবে নূতন
ফসল।
সেদিন বিকেলবেলা এইখানে নদীর
কিনারে
যে-সকল ছেলেমেয়ে চোখে মুখে ছড়াবে
আলোক
রামধনু-রঙ-আঁকা মুঠি মুঠি তাদের
ঝিনুক
দু’হাতে ছিটায়ে যাবে-হবে চন্দ্রমল্লিকার বন।
অপরূপ রূপকথা- তবু বসে কান পেতে
শুনি-
এইখানে ভানুমতী মন্ত্র পড়ে
জাদুকাঠি হাতে,
ছায়া হয়ে একদিন মিলায়েছে অনেক
দানব,
হাড়ের বিছানা-লে রাক্ষসেরার
গিয়েছে লুকায়ে।
ইটের পাঁজার ধারে সব শেষে এসেছিল
যারা
তারাও ইঁটের গায়ে মিশে গেছে
অট্টহাসি হয়ে,
ঘুমায় ঢিবির নিচে সিংহাসনে বত্রিশ
পুতুল,
নূতন কালের তা’রা অন্তরীক্ষে কোলাহল করে ।
ব্যক্তমধ্য
ব্যাপারটা কী?
কোথাও কিছু নেই
হঠাৎ ছোট একটা বিন্দু
তারপর বিরাট আকার
প্রচন্ড হুংকার –
‘অয়মহম ভো।‘
তারপর আবার ছোট একটি বিন্দু
তারপর কিছু নেই ।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
বিরাট কবি তিনি। তাঁকে ভুলে যাওয়া বর্তমান বাঙালি পাঠকের গণ্ডীবদ্ধতাই প্রমাণ করে। ধন্যবাদ।
ReplyDelete