• কবিতা সুর্মা


    কবি কবিতা আর কবিতার কাজল-লতা জুড়ে যে আলো-অন্ধকার তার নিজস্ব পুনর্লিখন।


    সম্পাদনায় - উমাপদ কর
  • সাক্ষাৎকার


    এই বিভাগে পাবেন এক বা একাধিক কবির সাক্ষাৎকার। নিয়েছেন আরেক কবি, বা কবিতার মগ্ন পাঠক। বাঁধাগতের বাইরে কিছু কথাবার্তা, যা চিন্তাভাবনার দিগন্তকে ফুটো করে দিতে চায়।


    সম্পাদনায়ঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়
  • গল্পনা


    গল্প নয়। গল্পের সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করতে চায় এই বিভাগ। প্রতিটি সংখ্যায় আপনারা পাবেন এমন এক পাঠবস্তু, যা প্রচলিতকে থামিয়ে দেয়, এবং নতুনের পথ দেখিয়ে দেয়।


    সম্পাদনায়ঃ অর্ক চট্টোপাধ্যায়
  • হারানো কবিতাগুলো - রমিতের জানালায়


    আমাদের পাঠকরা এই বিভাগটির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন বারবার। এক নিবিষ্ট খনকের মতো রমিত দে, বাংলা কবিতার বিস্মৃত ও অবহেলিত মণিমুক্তোগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে আনছেন, ও আমাদের গর্বিত করছেন।


    সম্পাদনায় - রমিত দে
  • কবিতা ভাষান


    ভাষা। সে কি কবিতার অন্তরায়, নাকি সহায়? ভাষান্তর। সে কি হয় কবিতার? কবিতা কি ভেসে যায় এক ভাষা থেকে আরেকে? জানতে হলে এই বিভাগটিতে আসতেই হবে আপনাকে।


    সম্পাদনায় - শৌভিক দে সরকার
  • অন্য ভাষার কবিতা


    আমরা বিশ্বাস করি, একটি ভাষার কবিতা সমৃদ্ধ হয় আরেক ভাষার কবিতায়। আমরা বিশ্বাস করি সৎ ও পরিশ্রমী অনুবাদ পারে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরটি সম্পর্কে সজাগ করে দিতে।


    সম্পাদনায় - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
  • এ মাসের কবি


    মাসের ব্যাপারটা অজুহাত মাত্র। তারিখ কোনো বিষয়ই নয় এই বিভাগে। আসলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কবিকে নিজেদের মনোভাব জানাতে চাই। একটা সংখ্যায় আমরা একজনকে একটু সিংহাসনে বসাতে চাই। আশা করি, কেউ কিছু মনে করবেন না।


    সম্পাদনায় - নীলাব্জ চক্রবর্তী
  • পাঠম্যানিয়ার পেরিস্কোপ


    সমালোচনা সাহিত্য এখন স্তুতি আর নিন্দার আখড়ায় পর্যবসিত। গোষ্ঠীবদ্ধতার চরমতম রূপ সেখানে চোখে পড়ে। গ্রন্থসমালোচনার এই বিভাগটিতে আমরা একটু সততার আশ্বাস পেতে চাই, পেতে চাই খোলা হাওয়ার আমেজ।


    সম্পাদনায় - সব্যসাচী হাজরা
  • দৃশ্যত


    ছবি আর কবিতার ভেদ কি মুছে ফেলতে চান, পাঠক? কিন্তু কেন? ওরা তো আলাদা হয়েই বেশ আছে। কবি কিছু নিচ্ছেন ক্যানভাস থেকে, শিল্পী কিছু নিচ্ছেন অক্ষরমালা থেকে। চক্ষুকর্ণের এই বিনিময়, আহা, শাশ্বত হোক।


    সম্পাদনায় - অমিত বিশ্বাস

Friday, January 15, 2016

রঞ্জন মৈত্র

৫) আপনি বললেন, সুবর্ণরেখা রানওয়ে একটা কনসেপ্ট। এই কনসেপ্ট সম্বন্ধে একটু বিস্তারিত জানতে চাই আমরা আপনার মুখ থেকে।

৫) প্রথমেই বলি, আমি বলেছিলাম রানওয়ে একটা কনসেপ্ট । তো, দ্যাখো তুষ্টি , প্রত্যেক মানুষের স্বপ্নে একটি নিজস্ব দৌড়পথ থাকে । একজীবন ধরে সে এই পথটিকে লালন করে যায় । বেশিরভাগই অসফল । তবু সে এই স্বপ্নের হাত ছাড়ে না । এমনকি যখন তার মাথা এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্লথ হয়ে এসেছে , যখন তার ব্যাটারিগুলো রিচারজেবল নয় আর, তখনও । তখনও সে মনে মনে লাল বল হাতে সবুজ ঘাসের পথে রান আপ শুরু করে উজ্জ্বল রোদের আবহে । আমাদের সাধারণ জানাশোনায় রানওয়ে বলতে বিমানবন্দরের ছবি ভেসে ওঠে । তবে তার বিশাল আয়োজন , আবহ , কৃৎকৌশল সব ছাপিয়ে কিন্তু জেগে থাকে মহাশূন্যের দিকে ওই উড়ালটুকুই । সব অনুষঙ্গ , আওয়াজ , ধ্বনি , ভিন্ন ভিন্ন আলোর ঝলক ও নির্দেশ , চলমান সিঁড়িটি , পেটের ভিতর লুকিয়ে পড়ার মত চাকাগুলি সবই ওই উড়াল নির্মাণের বিভিন্ন উপকরণ মাত্র । এবং মানুষের স্বপ্নে এই পথটি সোনায় রেখানো , গোল্ডলাইন্ড । কারণ , সর্বোচ্চ স্বপ্ন সবসময়ই সোনার । এই সোনা তার ধাতুপরিচয় ছাপিয়ে আরও কিছু , আরও অন্য কিছু । নদীটির ক্ষেত্রেও তাই । জলস্রোতের গুণারোপে সহস্রবার প্রাণচঞ্চল শব্দটি ব্যবহার করলেও আমরা তার প্রাণটিকে সেইভাবে বিশ্বাস করি না । তার বিভিন্ন ধ্বনিকে নানা উপমায় মুখের ভাষা দিয়ে উল্লেখ ক'রলেও তার উচ্চারণটি খুঁজে দেখার কারণ দেখি না । আমরা বলি "এত জানে তবু নদী কথা বলে না" । আর নদী বয়ে চলে । কোথাও সে প্রচুর পার ভাঙে , অনড় মাটিকে নড়ায় খুব বেশি ,  কোথাও একেবারেই কম । কোথাও সে বিশাল পাথরকে বয়ে নিয়ে যায় দেশান্তরে , ভেঙে টুকরো করে মহাশিলা । আবার কোথাও সে সামান্য পাথরকেও যুগের পর যুগ অবিকল রেখে তার দুই পাশ দিয়ে বয়ে অনির্বাণ ছবি তৈরি করে । এইই তার পরীক্ষা নিরীক্ষা তুষ্টি । এই তার রানওয়ে নির্মাণ যা প্রকৃতপক্ষে রানওয়ে ধারণাটিকেই নতুন নতুন গঠন গড়ন দিতে থাকে । আমরা সুন্দরের স্মৃতি হিসেবে জলধারার এইসব পরীক্ষা নিরীক্ষার পথে নির্মিত যে বিভিন্ন রেখাচিত্র , যে সব পেইন্টিং তাদেরকে ক্যামেরায় ধরে নিয়ে আসি । কিন্তু ঐসব শিল্পকর্মের পিছনে যে মাথা , যেসব আঙুল, তাদের একটু খোঁজ করা একটু পরশ পাওয়ার ইচ্ছেকে আমল দিই না তেমন । চলে আঁকে বাঁকে - তে খুশ হয়ে যাই । আঁক আর বাঁকের ভিতরে কত যে আবিষ্কারযোগ্য আনন্দ রয়ে যায় 'দুর্বোধ্য' হয়ে , মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায় হয়ে! তো তুষ্টি , যে কোন সৃজনকামী মানুষের ক্ষেত্রে এই নিজস্ব রানওয়েটির অবস্থান আরও তীব্র , আরও জটিল ও শিক্ষণীয় এবং আবিষ্কারযোগ্য সরলও বটে । তো, এ গেল ভণিতা । এবার নিজের কথা । পাঠক হিসেবে চোখ চালালে মনে হয় , আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ আমার আজান (ঋকবৈদিক , ১৯৮৯ )-এর পর্বটি ছিল প্রত্যক্ষ যা কিছু তাকেই অন্য রূপারোপে পেশ করা , কিছুদূর অন্য উচ্চারণেও। কিন্তু যথেষ্ট দার্শনিকতায় মায়ানো সেইসব লেখা । সবটাই ভেবেচিন্তে হত নাকি এমনিই এসে যেতো , নাকি অকাল-পাকামি তা আজ আর বলা সত্যিই মুশকিল । কিন্তু নিজের রানওয়েটি যে মাথায় আসে নি এটা বোঝা যায় । যেমন ... "বাঁকা রোদে তাকে ঠিক চেনাই গেল না ভাঙা জ্যোৎস্নায় তাকে মনে হ'ল দৃষ্টিবিভ্রম"----- এই উচ্চারণে শুরু করা কবিতা শেষ হয়, " যে শোক আমার নয় নশ্বর আগুন নাচে তার দেহ ঘিরে" ( অনশ্বর-১ ) --এই ভাবে ।এখানে দাহক মারক আগুনও যে নশ্বর , সেই উল্লেখটিই আলাদা করে পাওয়ার । অথবা খুব অল্প বয়সে অর্জিত বড় শোকের দার্শনিক কথাকে স্রেফ রোজকার সাংসারিক দৃশ্য দিয়ে ফ্রেম করা , আবেগ দিয়ে স্পর্শযোগ্য করে তুলতে চাওয়া----- "তুমি কাঁচা ঘুম ভেঙে দিয়ে বাড়ি চলে গেছ কথা ছিল ভোরবেলা গাছেদের তৃষ্ণা মেটাবো হলুদ বিড়াল এসে দাওয়ায় দাঁড়ালে দেব দুধ"  ( অনশ্বর -৩ ) । এবং যেখানে সুযোগ ছিল অজানা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ার সেখানেও সেটি টের পাওয়ার বদলে দর্শনের আশ্রয় নেয়া , যেমন  খাটের তলায় জমে যাচ্ছে রোদ এবার বেচে দেবো কিছুটা করে"-- এইভাবে যে কবিতার শুরু হচ্ছে তা পরের দিকে- মাটির ধুনুচি থেকে যে ধোঁয়া উড়ে যায় যে ধোঁয়া সরে আসে গোপনে যে ধোঁয়া সরল ক্ষেত হয়েছে তায় কি লোভ রেখেছ বীজ রোপণে"---এর দিকে চলে গেল ( এবার বেচে দেবো ) । এইভাবে 'সৈনিকের দিনলিপি' পর্যন্ত । জামা কবিতায় এসে একটি অনুভবকে চারদিক থেকে দেখার প্রয়াস লক্ষ্য করি পাঠক আমি। আর এই বই-এর শেষ কবিতা 'আমার আজান'-এ এসে প্রত্যক্ষ থেকে অন্য আলো বার করে আনার , অন্য অনুভুতি স্পর্শ করার পথটির সন্ধান পাই সোলো ট্রেকিং-এর পথটির আমার রানওয়ের "যেমন দুপুরবেলা প্রাচী স্টপেজে বাসের খালাসী ডাকে অসীমের দিকে ছোঁড়ে আলজিভ হাত" থেকে "খোলা জানলার পাশে বাসের খালাসির আলজিভের মতো জেগে উঠতে চাই হিমভোরে" পর্যন্ত মনে আনা যাক যে , দুপুরের দিকে বাসে যাত্রীসংখ্যা তুলনামূলক বেশ কমই থাকে তবুও , মালিকের শর্তাধীন কমিশনই যেখানে একটু সচ্ছলতার মুখ দেখায় , তাই খালাসি চেঁচায় প্রবল চেঁচায় একবার এক বাসের পিছনে লেখা দেখেছিলাম , কন্ডাক্টার লক্ষী / ড্রাইভার প্যাঁচা / হেল্পার যত পারবি চেঁচা --- কন্ডাক্টারের হাত দিয়ে পয়সা আসে তাই সে লক্ষী , ড্রাইভার তাকে বহন করে নিয়ে যায় তাই প্যাঁচা কিন্তু মূল বাস্তবতার দায়টি হেল্পার অর্থাৎ খালাসির ফলে সে চেঁচায় , এমনকি যখন বাসস্ট্যান্ডে কেউ নেই , কিংবা প্রায় কেউ নেই , তখনও সে শূন্যের দিকে হাত তুলে চেঁচাতে থাকে কোন সম্ভাব্য প্যাসেঞ্জারের উদ্দেশ্যে তার আলজিভই তার রেফারেন্স হয়ে দাঁড়ায় আর এক কবিতালেখক "খোলা জানলার পাশে" , অন্তর্মুখীনতা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার পথে , অনির্দেশ "তোমাকে" খোঁজার আকাঙ্খা সেই তীব্রতায় নিয়ে যেতে চায় যার একমাত্র প্রতিতুলনা বাসের খালাসির আলজিভ তুষ্টি , এসবই আসলে , এতকাল পর , 'সুবর্ণরেখা রানওয়ে' পর্যায়ে রঞ্জন মৈত্রর কবিতা- চলনটিকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা আমার ওই মুহূর্তগুলিতে ফিরে যাওয়া তো সম্ভব নয় আর তো অন্তর্মুখীনতা থেকে বেরিয়ে আসার , বিমূর্ত অনুভুতিকে শব্দে ধরার চেষ্টার সেই শুরু সুবর্ণরেখা রানওয়ে কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাতেই----- "সমস্ত দেওয়াল থেকে না হওয়া ভ্রমণ সব তাকিয়ে রয়েছে , পিলুর দূরবীন মনে করো"---- পিলু এক রাত্রিকালীন রাগিণী কবিতাটি "আলতো দুপুর"-এর দেখাটি রিভার্সে না-হওয়া ভ্রমণস্থানের ছবিগুলির দিকে আমি তাকিয়ে থাকার বদলে তারাই তাকিয়ে থাকে , ভ্রমণ জাগিয়ে তুলতে চায় রাত্রিকালীন , শান্ত চরিত্রের এবং সম্পূর্ণত নিবেদনমূলক রাগ পিলু- সুরটিই দূরবীন হয়ে বিমূর্ত সব ভ্রমণের অনুভব বয়ে আনতে থাকে এক অনুচ্চকিত (আলতো) দুপুরে এই পর্যায়ে একটি বিশেষ ভাবনাকে নানাভাবে এক্সপ্লোর করার কাজটি শুরু করেছিলাম পাঠক , মার্জনা করুন , কথাগুলো এতদিন পরে প্রথম পুরুষে বলছি বলে আসলে তৃতীয় পুরুষেরই গলা যার আরও একাধিক ভিন্নসুর ভিন্নদেখা সম্ভব যেমন 'ছুটি' কবিতায় ১নং অংশটি শুরু হয় ----- "দুপুর গন্ধবহ 'রে তোলার পদ্ধতির মধ্যে একটা নিপাট দোকান থেকে যায় , দোকানের পরিসীমার মধ্যে থেকে যায় একটা ছুটির দুপুর"--এইভাবে আর শেষ হয়--"এক ম্লান চপারকে দেখেছিলাম, কসাইয়ের তক্তাপোষের তলায় , ভ্যাপসা কাদায় , ছুটির মরিচায় "--- এই উচ্চারনে পাঠক, এই চপার , এই ছুটি হয়ে যাওয়া চপারকে আপনিও দেখেছেন এভাবে নানারকম বৈচিত্রে , সুবর্ণরেখার মতই , আমার এই পর্বটিও চলতে থাকে তুষ্টি যতদিন না এক ধূসর বিকেলে বারীনদার (ঘোষাল) সাথে গিয়ে দাঁড়াই দোমোহানিতে ( জামশেদপুর ) দেখি, খড়কাই নামের এক সুন্দর স্রোতস্বিনী চিরকালের মত মিলিয়ে যাচ্ছে সুবর্ণরেখার স্রোতে ছেলেমানুষের মতো মনখারাপ হয়ে গেল এই ভেবে যে খড়কাই আর কোথাও থাকল না খড়কাই হারিয়ে গেল পরে মনে হোল , পথে যেতে যেতে এসবই তো নদীর সমৃদ্ধি , তার দৌড়পথের স্বর্ণালী হয়ে ওঠা একটি প্রাকৃতিক জলধারার প্রকৃত সুবর্ণরেখা হয়ে ওঠা তুষ্টি , ছোটোবেলায় দেখতাম যে কোন বক্তৃতামঞ্চে দু' একজন স্পেশালিস্ট থাকতেন যারা মাইক ধরেই অবশ্যই বলতেন , সুধীবৃন্দ ( অথবা বন্ধুগন ) , আমি আপনাদের মূল্যবান সময় বেশি নষ্ট করতে চাই না এবং অন্তত দু' ঘন্টার আগে মাইক ছাড়তেন না যখন পরে কখনও নিজেরা আয়োজক হয়েছি এরকম ধরনের অনুষ্ঠানের তখনও এইসব স্পেশালিস্টদের নিয়ে ভীষণ টেনশনে থাকতাম যে এঁরা একবার মাইক পাকড়ালে বাকি বক্তাদের সময় সংকুলান কোরব কি করে ! তবে হোল এক প্রকৃত সমস্যা এবং প্রকৃতই এক ফিচলেমি কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠটি হোল এই , যে , অতক্ষণ ধরে বলতে 'লে , অতবড়ো করে বলতে 'লে সেইমত মালমসলাও মাথায় মগজে থাকা চাই তোমার মারফৎ তুষ্টি , আমি বাক-এর পাঠকদের কাছে মার্জনা চেয়ে জানাই যে , কোন বিষয়ে খুব বড়ো করে বলতে থাকার মতো , বলতে পারার মতো মালমসলা আমার ভাঁড়ারে নেই

৬) খড়কাইয়ের মত ছোট নদী মিশে যায় সুবর্ণরেখায় আর তার সোলো ট্রেকিঙয়ের পথটি আপনাআপনি তৈরি হয়ে যায়। তখনও কি সেই হেল্পার ছেলেটি শূন্যের দিকে হাতছানি দিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডেকে যায়? আর সেই যে মাইকধারী বক্তা, যার দুঘন্টার বক্তৃতার শেষে কিছুই বলা হল না আক্ষেপ কিছুতেই থামে না, তার তখন কী করণীয়?

৬) আসলে 'সুবর্ণরেখা রানওয়ে' বইটার কবিতাগুলো লেখার পর্যায়েই আমার নিজস্ব কবিতাপথটি খুঁজে পাই । সম্ভবত নিজস্ব কবিতা-ভাষাটিও , যদি সেরকম কিছু থেকে থাকে অবশ্য । যা 'আমার আজান' পর্যায়ে ছিল না । কবিতা যে বিশ্বময় ছড়িয়ে আছে , তার স্পর্শ পাওয়া , তাকে চিনতে পারা , নিজের উচ্চারণে লিপিত করা , নিজের সমস্ত অস্তিত্বের ভিতর দিয়ে ট্রেক করার আনন্দ , এই অভিযাত্রা আমাকে এবং আমার কলমকে প্রচুর জীবনীশক্তি এবং দেখার চোখ যোগান দিয়েছিল । ফলে হোল কি , খ্যাতি পরিচিতির উচ্চাকাঙ্ক্ষার চেয়ে নতুন নতুন অজানায় অভিযানের আনন্দই সমস্ত মনকে ছেয়ে ফেললো । আমার এক চাম্বাওয়ালা ভাই আছে , অশোক মিনহাস । কর্মসূত্রে থাকে অবশ্য সাংলা-য় ( কিন্নর ) । ট্রেকিং এবং পর্বতারোহণের গাইড । আমার মত ক্যাজুয়াল ট্রেকারকে সে একটা অসাধারন কথা বলেছিল , " উপর মত দেখিয়ে ভাইয়া । ব্যস অপনা স্টেপস ডালতে রহিয়ে" । অর্থাৎ , তুমি টার্গেট-এ কন্সেন্ট্রেট করলে ফ্রাস্ট্রেশনকে ডেকে আনবে । নিজের প্রতিটি স্টেপকে আবিষ্কার এবং উপভোগ হারাবে । বারীন দা লিখেছিলেন, প্রথম স্টেপটি ফেলার পর দ্বিতীয় স্টেপটি কোথায় হবে তার কোন পূর্বধারনা না থাকে না । কবি অজানায় পা ফেলে । অজানা , তাই অন্ধকার । স্টেপিং ইনটু ডার্কনেস । তো আমার মনে পড়ে যায় , আজ থেকে বহুবছর আগে আমরা চার বন্ধু অন্ধকারে চাঁদিপুরের সমুদ্রে সমুদ্র খুঁজতে হাঁটা লাগিয়েছিলাম । ওখানে তো অফিস-টাইম সমুদ্র ! দেখেছিলাম দশটা-সাড়ে দশটায় এসে হাজির হয় আর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ফেরত যায় চার কিলোমিটার ভিতরে । এখন আমরা তো বেশ অনেকদূর যাবার পর বিপদ হতে পারে এই অনুমানে ফেরত আসি । সত্যিই বিপদ হলে অবশ্য এই ইন্টারভিউটা মিস করতাম । কিন্তু আমার প্রাপ্তি এই হোল যে , অন্ধকার বালিতে একটা ক'রে পা ফেলছি আর পায়ের তলাটা আলো হয়ে যাচ্ছে । এই অভিজ্ঞতা তুষ্টি , এই-ই সেই অভিজ্ঞতা যা একজন কবিতালেখক লিপিত করে । একদম অজানা পথে , অন্ধকারে , তার প্রতিটি পদক্ষেপই আলো করে তোলে কোন অনন্য অভিজ্ঞতাকে । বেশির ভাগই তো এরকম অদ্ভুতুড়ে কান্ডকারখানা থেকে পালিয়ে যেতে চায় , বিশ্বাসও করে না । তারা তাদের মত করে ভালোই করে । যে যা ক'রে আনন্দ পাবে , তাইই করবে , সেটাই স্বাভাবিক । কিন্তু যে 'ওই' আনন্দটা পেয়ে যায় তার চলা চলতেই থাকে নিজস্ব ক্ষমতা , কল্পনা , প্রয়োগশক্তি ও তরঙ্গবিস্তারের ক্ষমতা অনুযায়ী । বিবেকানন্দ উচ্চারণ করেছিলেন " আত্মনং বিদ্ধি " , ঠাকুরমশাই লিখেছিলেন " আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না ", কিন্তু সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক কথাটি বলেছিলেন কাজী নজরুল , " আমি সহসা আমারে চিনেছি / আমার / খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ ' । বস্তুত এই-ই সোলো ট্রেকিং-এর পথটিকে অনুভবে পাওয়া । সমস্ত ইনহিবিশন থেকে মুক্তি । আর তখনই তুষ্টি , ওই হেল্পার ছেলেটি তার বাস্তবিক ভুখ , স্বপ্ন , সিন্সিয়ারিটি , তার শূন্যচারী হাত এবং আলজিভ সমেত বসত করে মাথার ভিতরে । চিরকালের মত । আর , শব্দে অক্ষরে নিজের অনুভবপ্রেরণ ও তরঙ্গবিস্তার এ পৃথিবীর অন্তত পাঁচজন পাঠকের মানস-তরঙ্গকেও স্পর্শ করবে এই স্বপ্ন ও বিশ্বাস একজন কবিকে টার্গেট-অডিয়েন্স নামক খপ্পর থেকে মুক্তি দেয় । আমার মনে হয় কবি একজন ভ্রামক আর পাঠকও তাই , ভ্রামক । নাহলে তাঁরা কবিতার কেউ নন । কোন কবির কাব্যগ্রন্থ পাঠও তাঁর সঙ্গে এক অপরূপ ভ্রমণই । অভিজ্ঞতাটা আলাদা আলাদা হয় , চেহারায় এবং চরিত্রে । এখন ট্যুরিজম , রুটিন প্রকৃতিবিহার এবং প্রকৃতিরচনার সঙ্গে এই ভ্রমণ ও তার ফসলকে কেউ যদি মিলিয়ে ফেলেন তো তাঁকে নমস্কার । করণীয় কে ঠিক করে দেয় তুষ্টি ! মাইক আছে , মাথায় প্রচুর কথা আছে , বোলতে রহিয়ে ভাই , হরজ কেয়া হ্যায় ! তো কবির যদি মাইকের ব্যাবসা থাকে বা মাঝে সাঝেই মঞ্চ-আয়োজনের এলেম থাকে , তিনি করণীয় বুঝবেন আর বক্তাকেও বোঝাবেন । আসলে আমি বেশি বলতে পারি না তুষ্টি । চেষ্টা করতে গেলে ভুলভাল বকতে থাকি । কিন্তু এটা একটা ওয়েব পত্রিকা , গড়ের মাঠ নয় , তাই হুঁশিয়ারিটা নিজেই নিজেকে দিতে হবে তো নাকি !

৭) কবি রঞ্জন মৈত্র এত কম লেখেন কেন? তাঁর চেঁচানি হাজার কান পাতলেও শোনা যায় না কেন? পাঠকরা কি বঞ্চিত থেকে যাবে?

৭) ওহো , বাক-এর বকুনিও খেতে হোল ! প্রাণের বন্ধু কবি ধীমান চক্কোত্তি তো আমাকে বকে বকে এলে গেছে , মানে হয়রান হয়ে গেছে । " তুই বসিসই না । লিখতে বসবি , তবে তো লেখা ! বাড়ি যা । বোস বোস । অমুকদিন চারটে কবিতা নিয়ে আসবি। " ব্যাস , আমার হাত পা বুক পেট সবই কাঁপতে থাকে । কবিভাই ব্রজকুমার সরকার একটা সাঙ্ঘাতিক প্রায় মন্ত্রের মত কথা বলেছিল , " লেখার মত না-লেখাটাও একটা অভ্যাস রঞ্জন দা " । কিন্তু এরকম জাগিয়ে তোলা কথার পরেও আমার সেই , কাঁপতে থাকে আর কি । আসলে তুষ্টি , আমি বেশি লিখতে পারি না । ব্যাক্তিগত জীবনও সময় অনুমোদন করতে চায় না একদমই । বহুবার এমন হয়েছে যে তিন লাইন কবিতা লেখার পর চতুর্থ লাইনটি আমি কয়েকদিন পরে লিখেছি , কিন্তু মাথাটা আর প্রথমদিনের জায়গায় নিয়ে যেতে পারি নি । তবে যারা পারে তারা এর মধ্যেই পারে । যাই হোক । পাঠক মাথায় থাকুন । আমি সামান্য মানুষ । বঞ্চিত অনেক বড় শব্দ । আর পাঠকেরও তো দেরি হয় তুষ্টি , অনেক দেরি হয়ে যায় , তাঁরা বুঝবেন ঠিকই।

৮) শোক বা দুঃখ, বিশেষ করে যে অল্প বয়সের শোকের উল্লেখ করেছেন, সেখান থেকেই কি এই কবিতা জন্ম নেয়? নাকি ভাঙনের শুরু?

৮ ) কবি দুঃখের অনুবাদক নন । তিনি আনন্দের সন্তান এবং পিতা বা মাতাও । দুঃখ যন্ত্রণা রক্তক্ষরণ সহ বহু ঘটনাসূত্রেই কবির কিছু অর্জন হয় । সেই আনন্দ । কবিকে সাথ দেয় তারা । বিনির্মাণের পরবর্তী পদক্ষেপটি যদি নির্মাণ না হয় তবে সে বিনির্মাণ বেকার বেমতলব এবং এটা কোন ঘোষণা নয় , আমার আঁতের কথা মাত্র । শুরু এক পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা আর ভাঙন এক পরিকল্পিত কার্যক্রম । কিন্তু ওই যে বললাম , সবই সাথ দেয় । তোমরা কিন্তু একটা ভারি-ভালোমানুষ কবিতালেখকের বারোটা বাজালে তুষ্টি । নিজের কথা , নিজের লেখার কথা , নিজের মুখে বলতে পারে না যে , কি বলবে খুঁজে পায় না , পেট গুড়গুড় করে সেই লোক কিনা আজ নিজের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছে ! কেয়া বাত !
 "শেষ বিকেলের বাজে কাগজের ঝুড়িতে
চকচক করছে যে
 দীর্ঘশ্বাস তা কার ! এই ফারাকের মধ্যে
ধীরে ধীরে সোজা হচ্ছে
একটি সাদা আলো। চেকপোস্ট বহির্ভূত
এই তার একবার মায়া-উত্থান।
ওকে ছোঁও, সাহায্য করো, বাথরুমে যেও
না। সাত রং-এর
স্ট্রাইপস ফুটে উঠুক তোমার ট্রেন ফেল
করা শার্টে ।
একবার হেসে ওঠো ডাস্টারের কানে"
( চেয়ারের আত্মা / সুবর্ণরেখা রানওয়ে )




My Blogger Tricks

7 comments:

  1. দুরন্ত আলাপচারিতা। প্রিয় কবির সংখ্যা এক বাড়লো

    ReplyDelete
  2. অনন্য....অনবদ্য

    ReplyDelete
  3. 'পাঠকেরও দেরি হয়ে যায়'অতি সত্য কথা বললেন রঞ্জন। বেশ কয়েক বছর আগে একটি পত্রিকায় স্বপন রায়ের লেখা রঞ্জন মৈত্রের কবিতার আলোচনা পড়েছিলাম। বিশ্বাস হয়নি। মনে হয়েছিল, রঞ্জনের কবিতার গা জোয়ারি ব্যখ্যান। তারপর থেকে রঞ্জনকে পড়তাম নিজের রানওয়েতে দাঁড় করিয়ে। আমার উড়ান হত না। রঞ্জন দাঁড়িয়ে থাকেন স্থির। আজ আমি এই ইন্টারভ্যু পড়ে স্তম্ভিত। এই আলোচনা মনে হচ্ছে, কবিদের নজরেই পড়বে বেশি, রঞ্জনও তাই এখানেও স্রোতমুখে অভঙুর উপল হয়ে থাকবে বলে অনুমান। রঞ্জন এখানে পাঠকের পাঠক, কবির কবি, আলোচকের আলোচক। এই তিন মুখ একত্রে তীক্ষ্ণ হলেই গড়ে ওঠে কবির অবয়ব। তুষ্টি, এই ইন্টারভ্যু আরো আরো পাঠকের কাছে নিয়ে যাবার কোন উপায় আছে? আছে নিশ্চই। সেই চেষ্টা করা যাক।

    ReplyDelete
  4. 'পাঠকেরও দেরি হয়ে যায়'অতি সত্য কথা বললেন রঞ্জন। বেশ কয়েক বছর আগে একটি পত্রিকায় স্বপন রায়ের লেখা রঞ্জন মৈত্রের কবিতার আলোচনা পড়েছিলাম। বিশ্বাস হয়নি। মনে হয়েছিল, রঞ্জনের কবিতার গা জোয়ারি ব্যখ্যান। তারপর থেকে রঞ্জনকে পড়তাম নিজের রানওয়েতে দাঁড় করিয়ে। আমার উড়ান হত না। রঞ্জন দাঁড়িয়ে থাকেন স্থির। আজ আমি এই ইন্টারভ্যু পড়ে স্তম্ভিত। এই আলোচনা মনে হচ্ছে, কবিদের নজরেই পড়বে বেশি, রঞ্জনও তাই এখানেও স্রোতমুখে অভঙুর উপল হয়ে থাকবে বলে অনুমান। রঞ্জন এখানে পাঠকের পাঠক, কবির কবি, আলোচকের আলোচক। এই তিন মুখ একত্রে তীক্ষ্ণ হলেই গড়ে ওঠে কবির অবয়ব। তুষ্টি, এই ইন্টারভ্যু আরো আরো পাঠকের কাছে নিয়ে যাবার কোন উপায় আছে? আছে নিশ্চই। সেই চেষ্টা করা যাক।

    ReplyDelete