Friday, January 15, 2016
ভাঙাচোরা
বাক্যের মাঠে
এই শহরের অরণ্যে পতঙ্গেরা হাওয়ার চেয়ে দ্রুততর। এই শহরের মহাকাশে মনোবেদনারা আলোর চাইতে বেশি দ্রুততায় উড়ে চলে। এখানে রাস্তায়
হাঁটতে আমার ভয় করে। এখানে ফুটপাথ বদল হয় মধ্যরাতে, অন্তর্বাস বদল হয় মধ্যরাস্তায় আর
বিছানা বদল হয় আচমকা --- এখানে অগ্নিলালাময় ট্র্যাফিকের গা ঘেঁষে ল্যাম্পপোস্টের হলুদ
একঘেয়েমির পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে শপিং মল। চোখে রাতচশমার আড়ালে পরীর দল নেমে আসে নিয়ন
আলোর বাগানে। দূরে দাঁড়িয়ে দেখে যত ফোতোবাবুর দল --- প্রেমিক, বেকার, মাতাল, পাগল,
বীমা-এজেন্ট, কেরানি ও কবি। দাঁড়িয়ে আঙুলচোষা যাদের জন্মগত ও সহজাত অধিকার । সুরঞ্জনাও
আজ আর ওইখানে যায় না … ওই যুবকদের সঙ্গে কথা বলতেও তার আর ভালো লাগে না … তাই মধ্যরাতেই একা একা জন্ম নেয় ক্যানভাস ভরানোর খোয়াব --- রতিচিহ্নের তারযন্ত্রের
মিড় ও গমকই সেখানে হেমন্তকাল নিয়ে আসে। তাহলে কোথায় আজ
প্রণামপত্র রেখে যাব ? আজ এক পৃথিবী থেকে ত্যাজ্য হতে হতে যখন অপর পৃথিবীও ক্রমাগত
অস্বীকার করছে আমাদের, তখন আর কী-ই বা উপায়, এই এক নো-ম্যান্স ল্যাণ্ডে আছড়ে পড়া
ছাড়া। এখানে এক গোলার্ধে যখন কেবলই মাটি খোঁড়া পুরোনো করোটির ভিড়, ট্রেঞ্চ থেকে
তুলে আনা গ্রেনেডক্লিষ্ট কবিদের শবদেহ, অন্য দিকে তখন শুধুই রম্যকুসুমের প্রসাধন
সম্পর্কিত সুগন্ধির দমবন্ধ শ্বাসবায়ু। এই দুই-ই শুধু ... সভ্যতার আলেয়া দর্শন... এই অর্ধদগ্ধ কলোসিয়ামের
ডেথ অপেরায় আর কোন তৃতীয় দৃশ্য নেই। অনিবার্য চুম্বন শেষে তাই আত্মহননই
সবচাইতে সমর্থনযোগ্য পরিত্রাণ।
পতনের রং ছিল কালো। তার স্তম্ভ জড়ানো বিষ ও
গ্রহণের রাত বরাবর প্রচলিত রবিগানগুলো পরিত্রাণ এড়াতে চেয়েছে। সকালে উঠে থাকার
সময়টুকু ছাড়া এই বিষযাপন রোববারের জটিলতা... কোনকিছুই আর শব্দবাহক নয়। সোনালি চুল
রাত, তোমার মাথার ভেতর আজ তাই, আমার হনন ইতিহাস।
ধরা যাক, এরকম একটা সময়ের টুকরোয় বসে আমি আত্মহত্যার বিকল্প হিসেবে কবিতা লিখি।
আদ্যন্ত ভীতু, আকাট, বোবা, মধ্যবিত্ত একজন আমি। তাই রাগ হলেও, হিসহিসে গলায়
উল্টদিকের লোকটার হাড় হিম করে দিতে পারি না। তাই দুঃখ হলেও হাউ হাউ করে কেঁদে নিয়ে
হাল্কা হতে পারি না। তাই খুব আনন্দ হলে সেই আমি বড়জোর এক ভাঁড় রসগোল্লা কিনে বাড়ি
ফিরতে পারি। তাই যে কথা আমার মুখে বলা হয় না, সে কথা চুপিচুপি আমার লেখায় চুঁইয়ে
নামে। যে পাহাড়, যে অরণ্য আমি দেখিনি কখনো, তারা এসে মাথা তোলে আমার কবিতায়। আমার
কবিতা আসলে সমস্ত না বলা, না দেখা, না হওয়ার কবিতা। এভাবেই আমি এক কল্পচেতনা
নির্মাণ করি। আমার কবিতা একদিকে যেমন আমি, তেমনই আমি-র না-ও। কবিতা দিয়ে আমি
কমিউনিকেট করি, উল্টোদিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। আমার তবুও চিরকুটে চিঠির
খসড়া লিখে কাচের বোতলে পুরে জলে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ঘুড়ি আটকানো বিদ্যুতের তারও এক ধরনের ঘরে ফেরার
জ্যামিতি। ছোট স্টেশনের টিঊবওয়েলে খোদাই ব্যর্থ স্বমেহনলিপি... ছড়িয়ে পড়তে চাওয়া
এরকম বিষণ্ণতার কারণেই একাকীত্ব নামের এক রেলযাত্রাও কখনোসখনো খুব ধোঁয়াটে
শূণ্যতার গান মনে করায়... হয়তো এসবই অন্ধত্ব নামের সেই বৃষ্টিপাতের পূর্বলক্ষণ
বলে, মধ্যবর্তী অপেক্ষার দিনগুলোয় ঘুম পেলেও চাঁদ ও বিষাদের জলপতনের কথা কেউ ভুলেও
বলে না। একলা ল্যাম্পপোস্টের নিচে পথভ্রষ্ট কুকুর কেবল শীতের রাত্তিরে আচমকা
পরিচিত শব্দ করে কান্নার পেচ্ছাপ ভাসায়...
কলকাতা শহরের মধ্যবিত্ত পাড়ায় কবিতা-অসুখে ভুগতে শুরু করেছি তখন, সদ্য কলেজ
যাপনের দিন... একা একা হাঁটতে ভালো লাগে, শহরের শেষ কয়েকটা গাছ, যা তখনও মরে
যায়নি, ভালো লাগা দেয় -- জীবনের প্রথম প্রেমিকা মায়াময় হাসির খোশবাই ছড়িয়ে বাই বাই
এঁকে চলে গেছে, লেখা চেয়ে আচমকা পোস্টকার্ড আসে একটা -- পাড়ার বন্ধুরা ‘মুকুলিত কবি’ বলে খুব মজা পায় – আর আমি আরও একটু নিজেই
নিজের কাছে গুটিয়ে যাই। আমার বেঢপ চেহারাটা হাসির খোরাক হয়। আমি নিজের মনে নিজের
সঙ্গে কমিউনিকেট করবার শব্দ খুঁজি কেবল। শব্দের দৃশ্যরূপ, শব্দের ধ্বনিরূপ – নিজের মতন করে তাদের ভাঙি,
নির্মাণ করি, প্লাস্টার লাগাই, ছেঁটে দিই... এইভাবে ক্রমাগত অচেনা হতে থাকা শহর
তবুও মাঝে মাঝে অন্যমনস্কতায় শুশ্রূষা দেয়।
ভাঙাচোরা বাক্যের মাঠে অনুবাদ হয়ে চলেছে চোখবাঁধা ঘাতকের দল। তাই আমরা অনেকেই
একা একা মাঝরাত্তিরে কবিতায় বেঁচে থাকি আজকাল। শব্দ আমার সবচাইতে বড় সঙ্গী। আর
গান। আর স্মৃতি। আমি আর এই তিন বন্ধু মিলে, নিজের মতন করে চারপাশের অনুভূতি
নির্মাণ করি। এভাবেই আমার আশেপাশে দৃশ্যের জন্ম হয়। লেটারবক্সের চারপাশ ঘিরে গোল
এঁকে উড়তে থাকে এক ঝাঁক মাথা খারাপ পাখি। আমি সেইসব দৃশ্যের, সেইসব অনভূতি ও
অন্যান্য প্রবাহের লিপিকার মাত্র। তার জন্যেই আমার শব্দ সন্ধান। রাস্তা খোঁজা...
ঘুমের দোলনা বেয়ে নেমে এলাম শরীরে শরীরে – প্রশ্বাসে
রেখেছি দুয়েকটা লাজুক আয়না। অথচ সেখানে তো ছায়া নেই – কেবল পার্কের
খেলা, ছোঁয়াছুঁয়ি আর একা বসন্তবৌরির ডাক – আড়মোড়া ভাঙা
তারপর মাঝরাতে ঘুম না হওয়া ভয়, দমবন্ধ করা – নোনতা নোনতা
স্বাদ কখন যে আচমকা বৃষ্টির মধ্যিখানে একা একা বেশরম। কেবল প্রতিধ্বনিগুলো একমাত্র
বন্ধু...
আলোর ঝলকানির মতন শব্দ আসে। আবার ঝুপ করে চলে যায়। একটা অন্ধকার চোরাগলির
মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ। অন্ধের মতন রাস্তা হাতড়াই। শব্দের গন্ধ, শব্দের
ধ্বনি, শব্দের রূপ -- কথা কয় না, দেখা দেয় না... শব্দহীন, কবিতাহীন চাকরির একঘেয়ে
দিনগুলো ক্রমাগত আরও আরও খুন করে চলে আমায়। কেবল মাঝেমধ্যে সেই অন্ধকার গলির মধ্যে
আচমকা একটা বাজপাখির ডানার মতন কোনো শব্দ আটকে পড়ে ডিশ-অ্যান্টেনা টাঙানো আমার
শহুরে আকাশে। তেমন করে, আমরা অনেকেই একা একা মাঝরাত্তিরে কবিতায় বেঁচে থাকি আজকাল।
আমি নিজের লেখাটা নিজের মতন করে লিখতে চাই। কবিতা আমার কাছে এক জটিল শাস্ত্র। যার
কাছে পৌঁছতে চাওয়ার ধৃষ্টতা করতে চাইলেও অন্তহীন সাধনা লাগে। সঙ্গীত শাস্ত্র বলে,
দুটি স্বরের মধ্যবর্তী অংশে সহস্র শ্রুতি থাকে, তাকে কানে শুনে শুনে চিনতে হয়। এই
শোনাটুকু শিখতে হয়। যেমন শিখতে হয়, ছবির দেখাটুকু। সেইভাবে, কবিতার কাছাকাছি আসতে
চাই বলে, আমি চাই কবিতার পড়া-কে শিখতে। কবিতা আমার কাছে চিত্রকলা, ভাস্কর্য,
স্থাপত্য, নৃত্য, গীত, বাদ্য, নাটক, চলচ্চিত্র, ভূগোল, ইতিহাস, অর্থনীতি, বিজ্ঞান,
ভাষা – এই স-ব মিলিয়ে
এক অন্তহীন মহাকাশ। অথবা, তাদের পেরিয়ে আরও বিস্তীর্ণ কিছু।
অথচ লেখারা কি ধরা দেয় ইচ্ছেমতন ? আমার তাই মাঝেমধ্যে, অফিস কামাই করে সারাদিন
শুয়ে শুয়ে কবিতা পড়তে ইচ্ছে করে। আমি সারা বছর লিখতে পারি না। লেখা আসে না আমার। সেইসব
শিরোনামহীন খামোশি অথবা অবসন্ন স্নায়ুর মাঝরাতগুলোয় খুব কষ্ট হয় তখন।
সেরকম এক নীল বন্দরের স্বপ্ন আমরা প্রায়শই দেখি ও দেখেছি – যেখানে বন্ধ
ঘড়ির চাষ হয় রোজ এবং পথ হারানোই পেশা, সেরকম বধির দর্জিরা কুড়োনো ঝিনুক দিয়ে
আমাদের ছেঁড়া ও ম্যাড়ম্যাড়ে রাত গেঁথে দেয় ত্রিপলের পালে – যেখানে নৌকোর
গায়ে ইন্কার মানচিত্র, মাস্তুলে হলুদ শাড়ির পাড় ছেঁড়া – গোপনে তেমন
কষ্ট তুমিও পেয়েছ, লেপের ঢাকার নিচে মুছেছ শ্যাওলা, অপেক্ষা করেছ তার – যে বন্দর থেকে
কেউ একবার ভাষা ভুলে গেলে আর কোনোদিনও এক ফোঁটা লিখতে পারে না ...
কলকাতার বিখ্যাত এক ইংরিজি ইস্কুলে পড়া আমি চক্চকে না হয়ে উঠে কবিতার নেশায় মজেছি।
কিচ্ছু “হয়ে ওঠা” হয় নি আমার, আমি ভাসতে ভাসতে “কবিতা”-র খড়কুটো আঁকড়ে ধরেছি। ছোটবেলায় টের পেতাম না, কখন যে বাবার অফিস লকআউট হয়ে
গেছে, কারণ, ইস্কুলের টিফিনে মাখন-পাঁউরুটির কোনোদিন খামতি হয় নি। আমার গানের
ক্লাসে, আঁকার ক্লাসে কোথাও কোনো ধূসর আঁচড় পড়েনি। কেবল আমার বাবা, আমার মা আরও
একটু রোগা হয়ে যেত একটু একটু করে। কী খেত ওরা তখন – স্বপ্ন খেত ? গান খেত ? আমিও
এখন সেই স্বপ্ন খেয়ে বাঁচি। জীবনের প্রথম কবিতা পড়ার সভায় পকেটে করে মাত্র একটা কবিতা
লেখা কাগজ নিয়ে গেছিলাম। গিয়ে দেখি, সকলেই হয় মোটা মোটা ডায়েরি, অথবা ছাপা বই নিয়ে
গেছেন। আমি তাঁদের এখনও অবাক হয়ে দেখি ... আমার অতগুলো শব্দ লেখার মতন সাহস হবে কি
কখনও ? মাঝে মাঝে তাই কোনো একটা পাহাড়ি নদীর পাশে অনেকক্ষণ বসে থাকতে, কোনো একটা
নাম-না-জানা পাকদণ্ডী দিয়ে হাঁটতে ইচ্ছে করে বরং। আমি জানি, এই পৃথিবীর সমস্ত
কবিতারা সেখানেই বসে আছে। সমস্ত গান। ছবি। উপন্যাস। এক সামান্য কবিতা লেখক হওয়ার
চেষ্টা করে চলা আমার কাছে, আমার ভাষা হারানোর অন্ধ মাঠ পেরোতে পেরোতে তাদের কাছে
দু’দণ্ড বসে থাকার
ইচ্ছেটুকুই এক আনন্দ।
বহুজাতিক মৃত্যুর গন্ধ সিপ করে ঢোকে ধুনিজ্বলা চোরাগলিতে । অকাল স্তম্ভের
আলোরেণু আস্তরণ ফেলে দূরগামী রেলের কামরায়। অন্তক্ষরী সিটে কিছু তুলোফুল সাইকেল,
মেয়েদের স্কুলের পাশে পেন কেনার ভিড়, বিকেলে গন্ধের ক্লাসে লোক নেই, দূর দিয়ে বয়ে
যায় ম্যাটিনি শহর ফেরা বাস, মৃত্যুগুলি হেঁটে মরে, কাউকেই না পেয়ে চুপিচুপি উঠে
পড়ে কবিদের মনখারাপ ট্রেনে...
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment