• কবিতা সুর্মা


    কবি কবিতা আর কবিতার কাজল-লতা জুড়ে যে আলো-অন্ধকার তার নিজস্ব পুনর্লিখন।


    সম্পাদনায় - উমাপদ কর
  • সাক্ষাৎকার


    এই বিভাগে পাবেন এক বা একাধিক কবির সাক্ষাৎকার। নিয়েছেন আরেক কবি, বা কবিতার মগ্ন পাঠক। বাঁধাগতের বাইরে কিছু কথাবার্তা, যা চিন্তাভাবনার দিগন্তকে ফুটো করে দিতে চায়।


    সম্পাদনায়ঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়
  • গল্পনা


    গল্প নয়। গল্পের সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করতে চায় এই বিভাগ। প্রতিটি সংখ্যায় আপনারা পাবেন এমন এক পাঠবস্তু, যা প্রচলিতকে থামিয়ে দেয়, এবং নতুনের পথ দেখিয়ে দেয়।


    সম্পাদনায়ঃ অর্ক চট্টোপাধ্যায়
  • হারানো কবিতাগুলো - রমিতের জানালায়


    আমাদের পাঠকরা এই বিভাগটির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন বারবার। এক নিবিষ্ট খনকের মতো রমিত দে, বাংলা কবিতার বিস্মৃত ও অবহেলিত মণিমুক্তোগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে আনছেন, ও আমাদের গর্বিত করছেন।


    সম্পাদনায় - রমিত দে
  • কবিতা ভাষান


    ভাষা। সে কি কবিতার অন্তরায়, নাকি সহায়? ভাষান্তর। সে কি হয় কবিতার? কবিতা কি ভেসে যায় এক ভাষা থেকে আরেকে? জানতে হলে এই বিভাগটিতে আসতেই হবে আপনাকে।


    সম্পাদনায় - শৌভিক দে সরকার
  • অন্য ভাষার কবিতা


    আমরা বিশ্বাস করি, একটি ভাষার কবিতা সমৃদ্ধ হয় আরেক ভাষার কবিতায়। আমরা বিশ্বাস করি সৎ ও পরিশ্রমী অনুবাদ পারে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরটি সম্পর্কে সজাগ করে দিতে।


    সম্পাদনায় - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
  • এ মাসের কবি


    মাসের ব্যাপারটা অজুহাত মাত্র। তারিখ কোনো বিষয়ই নয় এই বিভাগে। আসলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কবিকে নিজেদের মনোভাব জানাতে চাই। একটা সংখ্যায় আমরা একজনকে একটু সিংহাসনে বসাতে চাই। আশা করি, কেউ কিছু মনে করবেন না।


    সম্পাদনায় - নীলাব্জ চক্রবর্তী
  • পাঠম্যানিয়ার পেরিস্কোপ


    সমালোচনা সাহিত্য এখন স্তুতি আর নিন্দার আখড়ায় পর্যবসিত। গোষ্ঠীবদ্ধতার চরমতম রূপ সেখানে চোখে পড়ে। গ্রন্থসমালোচনার এই বিভাগটিতে আমরা একটু সততার আশ্বাস পেতে চাই, পেতে চাই খোলা হাওয়ার আমেজ।


    সম্পাদনায় - সব্যসাচী হাজরা
  • দৃশ্যত


    ছবি আর কবিতার ভেদ কি মুছে ফেলতে চান, পাঠক? কিন্তু কেন? ওরা তো আলাদা হয়েই বেশ আছে। কবি কিছু নিচ্ছেন ক্যানভাস থেকে, শিল্পী কিছু নিচ্ছেন অক্ষরমালা থেকে। চক্ষুকর্ণের এই বিনিময়, আহা, শাশ্বত হোক।


    সম্পাদনায় - অমিত বিশ্বাস

Friday, January 15, 2016

ধনপতির সিংহল যাত্রা ও মৌসুমি সমুদ্রের উপকুল

ধনপতির সিংহল যাত্রা ও মৌসুমি সমুদ্রের উপকুল: গ্রন্থ সমালোচনা
সাদিক হোসেন ও শুভদীপ মৈত্র

দেড়শ বছরের উপর পেরিয়ে যাওয়া বাংলা কথা সাহিত্যের ইতিহাসের শুরু ইতিহাসের পুনরগঠন দিয়েই। ঐতিহাসিক উপন্যাসের হাত ধরেই বাংলা উপন্যাসের পথ চলা শুরু, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ঔপনিবেশিক শাসনের শিখর সময়ে বাংলা সাহিত্যের যে আধুনিক উপন্যাসের প্রবর্তন করেন তার জন্‌রা ঐতিহাসিক উপন্যাস। সে ছিল জাতীয় সাহিত্য তৈরির সময় ফলে ঐতিহাসিক উপন্যাসের অন্তরালে গল্পের বিন্যাসে বারবার উঠে এসেছিল জাতীয় ইতিহাসের নির্মাণ এবং তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের সাহায্যপুষ্ট যে তথাকথিত নবজাগরণ, সেই নবজাগরণের আদর্শ। বাংলা সাহিত্যে তারপর থেকে ঐতিহাসিক উপন্যাস সেই পথ ধরেই এগিয়েছে। এবং বহুদিন ধরেই সেই দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যায়ওনি। ফলে তার কথন বা গঠনশৈলিতেও ঔপনিবেশিক সাহিত্যের অনুসরণ সবসময়েই প্রাধান্য পেয়েছে।
দেড় শতাব্দী পেড়িয়ে এসে আমরা যখন ইতিহাসকে দেখব, তাকে ব্যবহার করব গল্প বলার মাধ্যমে তখন নিশ্চয় সেই চেহারাচরিত্রের আমূল বদল ঘটে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। বিশ শতকের দুটি সম্পূর্ণ বাংলা উপন্যাসের আলোচনা করলে সে বিষয়ে কিছু আলোকসম্পাত করা যাবে, একটি হল রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের ধনপতির সিংহল যাত্রা, দ্বিতীয়টি হল অভিজিৎ সেনের মৌসুমি সমুদ্রের উপকুলবঙ্কিম প্রচলিত ঐতিহাসিক উপন্যাসের বিপ্রতীপে দাঁড়ানো এই দুই উপন্যাসই ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে ব্যবধান তৈরি করছে, যার থেকে নতুন ধরনের কথন তৈরির আভাস আমরা পাচ্ছি।
ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গীকে গুরত্ব না দিলে ইতিহাস নির্মাণের ব্যাপারটা স্পষ্ট হয় না, গায়েত্রী চৌধুরী স্পিভাক যখন বলেন, third world expresses the desire of the people in the first world for a manageable other. আমরা তার সঙ্গে সহমত না হয়ে পারি না, কারণ বঙ্কিম প্রবর্তিত ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় চোখে পড়ে না। আর তার কারণ সেই নবজাগরণ ঔপনিবেশিক শাসকের ধ্যান ধারণায় পুষ্ট হয়েছে। মৌসুমি সমুদ্রের উপকুল এর মতো উপন্যাস লেখার সময় সেই দৃষ্টিভঙ্গীকে প্রশ্ন না করে উপায় থাকে না। কারণ উপন্যাসটির বিষয় ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়ার দিকে বাংলার ইতিহাস। এবং সেক্ষেত্রে নবজাগরণ বা বাংলার রেনেসাঁ সম্পর্কিত যে ধারণাগুলো তার উপর দাঁড়িয়ে উপন্যাসটি লেখা সম্ভব ছিল না, যেমন ছিল না সেই নবজাগরণের প্রেক্ষাপটকে প্রশ্ন না করে।
বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে যে আধুনিকতা ও ইউরোপীয় শাসনের মধ্যে থেকেই হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রশ্রয় তাকে যেন সরাসরি প্রশ্ন করেই এই উপন্যাসের শুরু, উপন্যাসের কথক যখন মন্তব্য করেন, শতাধিক বছর আগে রঘুনন্দন নতুন করে কিছু বিধান হিন্দু সমাজে চাপিয়েছে বটে কিন্তু সে সব যত না মর্মান্তিক হয়েছে, তার থেকেও কুল পঞ্জিকারগণের প্রতিষ্ঠিত নিত্য নতুন নিয়ম, প্রথা, অহংকারের মিথ্যা কুল রীতি সমাজকে ক্রমশ সংকুচিত করে ফেলেছে
কৌলিন্যপ্রথা সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ণ যে এই রীতি নিম্নবর্গের মধ্যেও ব্যাপারটা চারিয়ে গেছে। এবং হিন্দুসমাজের যে প্রচার, কৌলিন্য প্রথা তার সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে প্রবল ধর্মান্তরিকরণের মুখে তা নিয়ে এই উপন্যাস প্রশ্ন তুলেছে। উপন্যাসের দুই প্রধান চরিত্র বিষ্ণুপ্রিয়, ক্ষেমংকর হয়তো এই প্রথার বিরুদ্ধে, কিন্তু সে সময়ের সমাজ ক্রমশ কঠিন অনুশাসনের মধ্যে ঢুকে পড়ছে, চৈতন্যর ভক্তি আন্দোলন অস্তমিত ও ব্যর্থ।
জাতিরক্ষার একটা কারণ উপন্যাসে বলা হচ্ছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, একটা তিমিঙ্গিল অবস্থা মুঘল শাসনের প্রাসন্তিক অবস্থানে মগ ফিরিঙ্গি আক্রমণ করছে, দখল করতে চাইছে এলাকা, তাদের অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি বিস্তারে আর সেই কারণেই লুঠ অত্যাচার, দাস ব্যবসা।
কিন্তু এর মধ্যে দাঁড়িয়ে আউলাকেশি, শর্মিষ্ঠা, সত্যভামার মতো চরিত্রদের কারো সমাজে ফেরার উপায় নেই, হয় ধর্মান্তরিকরণ নয় আত্মহত্যা এ ছাড়া উপায় কী? প্রায়শ্চিত্ত বিধান যা রয়েছে তাতেও মৃত্যু অনিবার্য। এবং শুধু এই মহিলা নয়, একই সঙ্গে তাদের পরিবারে বংশপরম্পরায় থেকে যাবে দাগ, নিষ্কৃতি নেই কোনো। এমন অবস্থায় উপন্যাসে দেখি ক্ষেমংকর বা শর্মিষ্ঠা ধর্মান্তরিকরণে বাধ্য হচ্ছে। তাই জাতিরক্ষার নামে একটা বিশাল অংশের মানুষ ধর্মচ্যুত হতে বাধ্য হচ্ছে, এবং এটা জোর করে নয়, বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর নিজস্ব সংস্কারের ফলেই।
মুঘল আমলে সুশাসনের জন্যও অন্তত শুধু ধর্মীয় বিরোধ নয় সহিষ্ণুতা দেখাতেই হত, পরস্পর দুই ধর্মের মানুষের মেলামেশা দরকার হয়ে পড়ত। ক্ষেমংকরকে দেখি আমরা কবিরাজ, সে তার জীবিকার কারণে শাসক শ্রেণির সঙ্গে মেলামেশা করে। উপন্যাসে আরো দেখি যদিও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যচার সীমা ছাড়াচ্ছে, তবুও গরীব কৃষক, নিম্নবর্গের মানুষ, গরীব মানুষ, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে জড়িয়েমড়িয়ে রয়েছে। তাদের ভাষা ও কৃষ্টিতে মিশ্রণ ঘটছে, এবং সে ভাষা বা সে কৃষ্টি কোনো বিশেষ আদর্শ বা ধারণায় পুষ্ট উচ্চশ্রেণির নয়, বরং সম্পূর্ণ নিজস্ব। এখানেই বাংলার তথাকথিত জাতীয় রেনেসাঁ-র থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে দেখাটা। ইংরেজ শাসনের আগে এবং মুঘলদের শেষ সময়ে তখনও কোনো নির্দিষ্ট ডায়ালেক্ট মুখ্য হয়ে ওঠেনি। অর্থাৎ শান্তিপুর নবদ্বীপের ডায়ালেক্ট মান্য বাংলা হিসেবে জায়গা করে নেয়নি। ভাষাগত মিশ্রণ চলছে, আরবি, ফার্সি, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ সব ভাষা থেকে শব্দ ঢুকছে হুহু করে।
সন্দ্বীপ, ডিয়াঙ্গা (দেবগ্রাম), চট্টগ্রাম, যশোর জুড়ে বহু জাতি, বহু স্বর, বহু রকমের কর্মকাণ্ড এ যেন উপনিবেশ তৈরির গবেষণাগার। উপন্যাস জুড়ে এই চেহারাটাই ফুটে ওঠে, এই উপন্যাসে ব্যক্তি চরিত্র কোনোভাবেই ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তার সম্পর্কটি। জর্জ লুকাচ তার হিস্টোরিকাল নভেল এ লিখেছেন ওয়াল্টার স্কট সম্পর্কে He always starts by showing how important historical changes affect everyday life,  the effect of material and psychological changes upon people who react immediately and violently to them, without understandin their causes…’ অভিজিৎ সেনের এই উপন্যাসেও আমরা তেমনটা দেখতে পাই খেমংকর, আউলাকেশি এরা সবাই সাধারণ মানুষ যারা ইতিহসের ঘূর্ণবর্তের মধ্যে পড়েছে এবং তাদের প্রতিক্রিয়া থেকে আমরা সেই সময়ের চিহ্নগুলোকে নির্দিষ্ট করছি
এই চরিত্রগুলি ঐতিহাসিক চরিত্র নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কাল্পনিক কিছু সাধারণ মানুষ যারা কোনোভাবেই ইতিহাসের কোনো বড় ঘটনাবলীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়, বা তাকে প্রভাবিতও করে না, কিন্তু এদের প্রতিক্রিয়া এদের জীবনের গল্প থেকে আমরা ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরার যে গ্র্যান ন্যারেনিভ তার একটা অপর পাঠ পাই। যে চরিত্রগুলি রয়েছে, তাদের সম্মিলিত রূপ দেখে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে আমরা রেনেসাঁর-র যে ভিত্তিভূমি দেখছি, তা আদৌ কার, এবং একটা বিশাল অংশের মানুষ কি তার থেকে বাদ পরে গেল না?
বস্তুত বাংলার চাঁদ, শঙ্খ, ধনপতিদের হারিয়ে যাওয়া বাণিজ্য সুজা বাদশা, মিরজুমলা, শায়েস্তা খান, আকিম উশসানের সহায়তায় নতুন ভরকেন্দ্র তৈর করল
এই অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটি দেখছে ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়ার সময়কে। রাজনৈতিক অবস্থা দুর্বল হচ্ছে এবং মধ্যযুগীয় অর্থনীতির থেকে মার্কেন্টাইল অর্থনীতিতে বদলে যাচ্ছে, এই বদলে স্বাধীন বাণিজ্য অবাধ হচ্ছে আরো, তা নিয়েই হানাহানি চলছে প্রায় দুশ বছর ধরে। এক দিকে যেমন মগ ফিরিঙ্গি হার্মাদ অন্য দিকে মুঘল শাসকদের একাংশও বুঝতে পারছে এই বাণিজ্যের গুরুত্ব এবং তাতে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করছে। মশলা, নুন, চাল এর রফতানি এবং একই সঙ্গে দাস ব্যবসা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের অন্ধকার দিক উপন্যাসে এসেছে, এবং সামাজিক পরিস্থিতি যে আসলে তার অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে আছে সেটাও খুব স্পষ্ট।
একটা নির্মোহ কথন তৈরি হচ্ছে উপন্যাসে যেখানে ঘটনাপরম্পরা ঐকিক কিছু নয়, বরং যেন একটা বিশ্লেষণী দূরত্ব বজায় থাকছে এবং সে সময়ের কুশীলবদের দেখাও হচ্ছে শুধুমাত্র সময়ের এবং অবস্থার আজ্ঞাবহমাত্র।  এবং কারো প্রতি কোনো অতিরিক্ত সমবেদনা জাগছে না।
যেমন চট্টোগ্রাম সংলগ্ন দাসবাজারের বর্ণনায় দেখি এর সঙ্গে শুধু পর্তুগিজ বা মগেরা জড়িত নয়। ওলন্দাজ, মুঘল এবং বাঙালিরাও একইরকম রয়েছে। ভরার মেয়ে-দের যে বর্ণনা, তাও তো এক ধরনের দাসব্যবসাই বটে, যুগল সাধুর মতো চরিত্রও রয়েছে বা ত্রিপুরাশঙ্কর, যে ঘটকালীর আড়ালে মেয়েদের বিক্রি করে এবং সেই ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত কুলীন প্রথার জন্যই।
আর সেই কারণেই যে নারী চরিত্রগুলি রয়েছে আউলেকেশি, শর্মিষ্ঠা, সত্যভামা, মঞ্জরী, মাধবী কারো দেখি কোনো নিজস্ব স্বাতন্ত্র নেই, কারণ সমাজে এদের কোনো জায়গাই নেই। প্রত্যেকেই পুরুষের ব্যবহারের সামগ্রী মাত্র। এরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সময় ধর্ষিতা হচ্ছে এবং তা সবসময় শুধু মগ বা হার্মাদদের হাতে নয়। আসলে সেই সমাজ ব্যবস্থায়, যৌনতা ও সন্তান উৎপাদন ছাড়া আর কিছুই তাদের প্রয়োজন আছে বলে মনে করা হয় না, ফলে গৃহপালিত জন্তুর থেকে বেশি কিছু তারা নয়। আউলাকেশি বা শর্মিষ্ঠা ব্যতিক্রম, তারা ধর্মান্তরিকরণের সাহায্যে অন্তত কিছুটা নিষ্কৃতি পাচ্ছে, কিন্তু তার জন্য তাদের ছাড়তেও হচ্ছে অনেক কিছু।
 সম্পূর্ণ ঘটনাবলীকে একটা ফ্র্যাকচারড ন্যারেটিভে ধরা হয়েছে উপন্যাসে। এখানে ফ্যাবুলা ও জুজেত-এর মধ্যে ফারাক রয়েছে বিশাল, ঘটনা পরম্পরাকে পরপর গল্প বলার ঢঙে উপস্থিত না করে আগুপিছু করা হয়েছে, আর এর অভিঘাতে পাঠকের কাছে কোনো মতেই একটা নির্দিষ্ট আবেগ তৈরি হচ্ছে না, বরং বারবার আবেগটা ভেঙে যাচ্ছে, আর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জটিলতার প্রতি সজাগ থাকতে হচ্ছে। ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে সাধারণত যে টানটান একটা গল্পের কাঠামো দেখি যা প্রায় ফ্যান্টাসিতে পরিণত হয়, যেমন শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাস, সেটা এখানে নেই। তার বদলে, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, মুঘল, উচ্চবর্ণের হিন্দু, গরিব কৃষক প্রত্যেকের স্বর একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে একটা কথন তৈরি করছে, এবং কথকের নিজস্ব স্বর সেগুলোকে বাঁধছে একসঙ্গে। বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসের যে পরিচিত কাঠামো, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শরদিন্দু তার থেকে সরে যেতে পারছে।
রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের ধনপতির সিংহল যাত্রা-তেও একটা ভিন্ন কথন তৈরির প্রয়াস রয়েছে। মধ্যযুগের বাংলা যখন বিষয়, এবং মঙ্গল কাব্যের পুনর পাঠ। সেই আখ্যানের ভাষা কি হবে? ঔপনিবেশিক শাসন ও তার পরবর্তিতে তৈরি বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে সমস্যা হল তা কখনই সেই সময়ের ভাষার কাছাকাছি নয়, রামকুমার একতি সম্পূর্ণ নিজস্ব শব্দভাণ্ডার তৈরি করেছেন এই উপন্যাসটির জন্য যা মধ্যযুগীয় ভাষা থেকে আহৃত। লুকাচ বলছেন একটা necessary anachronism দরকার হয় ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ পরবর্তী সময়ে দাঁড়িয়ে পুরনো কিছুকে নিয়ে লিখলে তাতে সমসয়ের ছাপ পড়বেই কিছু। ‌এবং এটা সব ধরনের সাহিত্যের ক্ষেত্রেই সত্যি। এ বিষয়ে তিনি গোয়েটে- কে উদ্ধৃত করছেন that all poetry in fact moves in the element of anachronism. whatever in the past we evoke, in order to recite it after our own fashion to our contemporary, we must grant a higher culture to the ancient happening than in fact had…’ রামকুমার কিন্তু এখানে এই জায়গাটা এরিয়ে গেছেন। একটা উচ্চ সংস্কৃতি বা আরো উন্নত সংস্কৃতি হিসেবে আধুনিক ও মধ্যযুগের ভাগটা তিনি করেননি। ফলে এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে আমরা ভাষাগত যে পিছন দিকে যাত্রা দেখি তা দরকারি হয়ে ওঠে। এই উপন্যাসের চেষ্টাটাই হল আধুনিকতার চশমায় মধ্যযুগকে না দেখা।
উপন্যাস হিসেবে ঐতিহাসিক তথ্যের সত্যতাকে বজায় রাখার একটা চেষ্টা থাকে, আধুনিক উপন্যাসের নিয়ম অনুযায়ী কল্পনাকে এমনভাবে উপস্থাপনা করা হয় যেন মনে হয়, যে কথনটি বাস্তব। কিন্তু এটাও তো একটা আধুনিক দেখা, সেই দেখার বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে ধনপতির সিংহল যাত্রা, চণ্ডী, মনসা প্রভৃতি দেবদেবী উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে চলে আসছে। উপন্যাসে এদের উপস্থিত আমাদের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীতে অবাস্তব এবং অনৈতিহাসিক, কিন্তু মধ্যযুগের টেকস্ট হিসেবে অপরিহার্য। সেই সময়ের দৃষ্টিভঙ্গীতে এটি বাস্তব, ফলে আধুনিকতা বাদ নিয়ে একটা কথন নির্মাণ করতে গেলে একে বাদ দেওয়া যায় না। বরং এর অন্তর্ভুক্তি আধুনিক সাহিত্যের বাস্তবতাকে ভেঙে দিচ্ছে।
এডোয়ার্ড সাইদ-এর মতে প্রাচ্য ধরাণা more a imaginative geography পশ্চিমের সাহিত্য ধারায় তাই বাস্তবের যে নির্মান সেটা প্রাচ্যের হতে পারে না যদি না সেটা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির প্রভাবে বদলে গিয়ে না থাকে। এই উপন্যাসে সেই বাস্তবতার সঙ্গে সাযুজ্য রাখার চেষ্টাও নেই। চণ্ডী, মনসা হোক বা ভৌগলিক বর্ণনা, কাল্পনিক অংশ বাস্তবের বর্ণনার সঙ্গে একই সঙ্গে মিশে রয়েছে। কালিদহ, সর্প দহ এগুলোর অস্তিত্ব ভৌগলিক নয় বরং কাল্পনিক। কমলে কামিনী দেখার যে অবিশ্বাস্য বর্ণনা কমলটির যেমন নয়নাভিরাম বর্ণ তেমন তার হৃদয়হর সুবাস। অভয়া হাস্যবদনা কামিনী রূপে উপবেশন করে কমলটিতে এর রেইজন দি আটার শুধুমাত্র ধনপতির মানসিক বিকার নয়, একই সঙ্গে একে দেখতে হবে চণ্ডী দেবীর চক্রান্ত হিসেবে। একই সঙ্গে এই দুই উপন্যাসটিকে বহুস্তরীয় করেছে। কথক একই সঙ্গে আধুনিক তার ভাষার প্রয়োগে, সে মুকুন্দরামের মতো ছন্দে লিখছে না, বভবহার করছে দাঁড়ি, কমা, সেমি কোলন প্রভৃতি, যদিও শব্দ ভাণ্ডার প্রাচীণ। আবার তার কথনের ভঙ্গীতে মধ্যযুগীয় কথকতার যে অবাস্তবতা তাও সে ছাড়ছে না।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ-এর জেনারেল অ্যাট হিজ ল্যবিরিন্থ-এও আমরা দেখেছি এমন নির্মাণ যেখানে সাইমন বলিভারের শেষ দিনগুলির এবং শেষ যাত্রাপথের বর্ণনা রয়েছে, এবং সেখানেও বাস্তবতাকে ভেঙে দিচ্ছে কথক। এবং কোথাও তা উপন্যাসে ঔপনিবেশিক ধারণাকেই আক্রমণ করছে।
মধ্যযুগের কথন নির্মাণে বারবার নানা তালিকার সাহয্য নেওয়া হয়েছে এই উপন্যাসে। সপ্ত ডিঙার বিশদ বিবরণ, রপ্তানি ও আমদানী দ্রব্যের বিশাল তালিকা তালিকার পর তালিকা এসেছে উপন্যাসে। এটা মধ্যযুগীয় সাহিত্যের বৈশিষ্ট বলছেন আমবার্তো একো, I read lots of medieval poetry and discovered how greatly middle ages loved enumerations. শুধু ইউরোপ নয় এটা বোধহয় যে কোনো দেশের মধ্যযুগ বা প্রাচীণ সাহিত্যের অঙ্গ। মঙ্গল কাব্য এর উদাহরণ রয়েছে প্রচুর, কালকেতুর শিকার বৃত্তান্তে এই তালিকার ব্যবহার করতে দেখা যায় কবিকঙ্কণ মুকন্দরামকে, যখন দেবীর কাছে পশুরা গিয়ে নালিশ করে। ফুল্লরার বারমাস্যাও একটি দীর্ঘ তালিকা। এবং বারমাস্যা মঙ্গলকাব্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তালিকার সাহায্যে ঘটনাপরম্পরার নির্মাণ রামকুমারও করেছেন এই উপন্যাসে। উপন্যাসের কথন জুড়ে নানা তালিকা দেখতে পাওয়া যায়, আকাশে নক্ষত্রদের অবস্থান থেকে শুরু করে খাবার ও রান্নার সামগ্রী, যাত্রা পথে দেখা পশু পাখি, গাছ পালা সব মিলিয়ে একটা জগৎ তৈরি হচ্ছে। বার বার এই তালিকার ব্যবহার বাস্তব অবাস্তব মিলিয়ে একটা পরিবেশ তৈরি করছে যা উপন্যাসের গল্প বলার মধ্যে সীমিত থাকছে না, ইতিহাস আর অনৈতিহাসিককে মিলিয়ে দিচ্ছে।
উপন্যাসটি পুরোটাই নির্ভর করে আছে ইন্টার টেক্সচুয়ালিটির উপর, ধনপতি, খুল্লনা, বা সিংহল রাজ বা কাল্পনিক চণ্ডী, মনসা সব চরিত্রই একাধিক মঙ্গল কাব্য থেকে সংগ্রহ করা। ঘটনাগুলিও একইভাবে তাই। এই উপন্যাসের নির্মাণ বৈশিষ্ঠ হচ্ছে যে সেই কথনগুলোর সত্যাসত্য বিচার করে বাস্তব একটি গল্প তৈরির চেষ্টাই করা হয়নি। বরং ওই টেক্সটগুলিকে স্বীকার করে নিয়ে তার থেকেই পুরো একটি টেক্সট তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে আবার আর্কাইক বা পুরা কাহিনীও হয়ে উঠছে না উপন্যাসের কথনটি। ফলে একেবারেই আধুনিক বা মধ্যযুগীয় এই দুটির দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক একেবারেই নেই। উপন্যাসটি এর বাইরে দাঁড়িয়ে একটা সময়ের আখ্যান নির্মান করতে সক্ষম হয়েছে।
এই দুটি উপন্যাসই প্লটকে বিসর্জন না দিয়ে তার কথনটাকে নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছে, এই পরীক্ষা বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে জরুরী ছিল, লিনিয়ার ন্যারেটিভ-এ আভ্যস্ত বাংলা উপন্যাস আর বিশেষ করে তা যদি ঐতিওহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখি তাহলে তো আরোই। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এই গল্প বলা থেকে সরেননি। ফলে বহুস্বরের দ্বন্দ্ব বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসে খুব সুচিন্তিতভাবে বিরল। এই দুটি উপন্যাস স্বার্থকভাবে সেই রাস্তা খুলে দিয়েছে, এবং নতুনভাবে উপন্যাসকে দেখার রাস্তা খুলে দিচ্ছে।

    



My Blogger Tricks

0 comments:

Post a Comment